ভাঙন
একটা গ্রুপ ফটো ।
অর্ধেক বারান্দা জুড়ে সিঁড়ি,
সেই সিঁড়ির ধাপে ধাপে বসে
ঠাকুরদা বাবা আর আমাদের প্রজন্মের
ছত্রিশ জন মানুষ।
সবাই বিশাল উঠোনের দিকে মুখ করে।
পেছনের সারিতে সিঁড়ির মাথায় বারান্দায়
দুটো চেয়ারে ঠাকুরদা আর ঠাকুরমা
পাশাপাশি একটু দূরত্বে বসে।
পরের ধাপে পাঁচ পিসিমা
প্রত্যেকের কোলে একজন করে শিশু,
পিসিমাদের মুখ দেখে বোঝা যায়
কে বড়, কে মেজো কে সেজো....
কিন্তু কোলের শিশুদের দেখে
বোঝার উপায় নেই কে বড় কে ছোট,
নিচের দুটো ধাপ কিশোর কিশোরী
কচিকাচাদের ভিড়
কারো পরনে আটপৌরে শাড়ি,
কারো ফ্রক,
ছেলেদের ইজের প্যান্টের
দড়ি সামনে ঝোলানো,
সবাই পরের প্রজন্মের ।
কিন্তু সেখানে আমি নাই,
কারণ আমি তখন মায়ের পেটে।
মা বসে আছেন বাঁদিকের আলসেতে
ঠিক বাবার পাশে ।
অন্যদিকের আলসেতে কাকা কাকিমা।
ঠাকুরমার হাতে জপমালা
ঠাকুরদা সামনের দিকে দূরে
তাকিয়ে, দৃষ্টি স্থির
যেন উঠোন, উঠোনের আলো পেরিয়ে
সামনের আমগাছটার উপর।
সাদাকালো ছবি অনেক কিছু অস্পষ্ট,
মাখামাখি।
এরমধ্যে সবচেয়ে যার মুখ স্পষ্ট,
তার নাম ইমান আলী।
তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা
তেল মাখানো চকচকে একটা লাঠি,
ঠিক উলম্ব ভাবে দাঁড় করানো পাশে,
পুরো গ্রুপটাকে যেন সামনে থেকে
পাহারা দিয়ে চলেছেন।
এরপর কতকাল গেল।
এখন গ্রুপ ফটো তুললে
আমি থাকি, মা থাকে না, বাবাও।
ছত্রিশ জনের একজনও থাকে না।
এতদিনে কতকিছু ঘটে গেছে।
দেশভাগ দাঙ্গায়
জমির ধানের গন্ধ মুছে গেছে।
যে বারান্দায় আমার হামাগুড়ি হাঁটা শেখা
সেই বারান্দা ভেঙে গেছে,
সেই চওড়া সিঁড়ির ধাপগুলোও ভেঙে গেছে,
ভেঙে গেছে প্রজন্মের সিঁড়ি।
কে কোথায় ছিটকে গেছে
এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে।
বড় হতে হতে বুড়ো হয়েছে সবাই।
ইমান আলী চাচা বলেছিল,
ভয় নেই দাদাঠাকুর,
ইমান আলির মুঠোতে
শক্ত করে ধরা আছে লাঠি ।
কিন্তু দেশভাগ দাঙ্গায়
লাঠি ভেঙে গেছে ইমান আলীর,
উঠোন ভেঙে গেছে,
এক দেশ অন্যদেশ হয়ে গেছে।
সাদা কালো গ্রুপ ফটোটা
আবছা হয়ে গেছে--
পোকায় কেটেছে কারো কারো মুখ।
-----------------------
© সঞ্জীব সাহা
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem