মানুষের হাতে বিষের কৌটা, এক উলঙ্গ উন্মাদ হা হা করে হাসছে। Poem by Arun Maji

মানুষের হাতে বিষের কৌটা, এক উলঙ্গ উন্মাদ হা হা করে হাসছে।

Rating: 5.0

তোমরা কেউ দিনের শেষে, আঁধার নামতে দেখেছো? দেখেছো- সূর্যটা কেমন দাউ দাউ করে জ্বলতে জ্বলতে, অবশেষে- ক্লান্ত হয়ে, সে আকাশের বুকে ঢলে পড়ে? সূর্য ডুবে গেলেও, তখনই কিন্তু আলো শেষ হয়ে যায় না! তখনও আকাশের বুকে- লাল লাল আভা, আর পৃথিবীর বুকে- সোনালী সোনালী আলো। এ সবই- সূর্যের কৃত, পুণ্য কর্মের ফল।

মালবিকা আমায় বলে- 'আমি কবেই মরে গেছি, অমল। তুমি আমার চোখে যা দেখো, তা গোধূলির আলো। একদিন সেই আলোও নিভে যাবে।'

কিছু কি বুঝলে তোমরা? একটু একটু পেরেছো, তাই না? আসলে জীবনের মধ্যেও, মানুষের বারবার মৃত্যু হয়। যারা কম শক্তির সূর্য, তারা মরে গেলেই, সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনে, ঘন আঁধার নেমে আসে। আর যারা মালবিকার মতো বেশী শক্তির সূর্য- তারা মরে গেলেও, তাদের আলোর বিচ্ছুরণ অনেকদিন থাকে। সেই আলোর বিচ্ছুরণ দেখে, তাদেরকে বোঝা যায় না যে- তারা ভেতরে ভেতরে মরে, ভূত হয়ে গেছে!

এরকম কত সহস্র মালবিকা, জ্বলতে জ্বলতে একদিন ক্লান্ত হয়ে, পশ্চিম আকাশে ডুবে যাচ্ছে। ডুবে গেলেও, তাদের চোখে তখনও- রাঙা রাঙা আলো, আর মুখে- সোনালী সোনালী হাসি। সেই রাঙা আলো আর সোনালী হাসিতে ভুলে গিয়ে, বোকা অমল বোঝে না- মালবিকা কবে মরে ভূত হয়ে গেছে।

আমরা সবাই মালবিকা, আমরা সবাই অমল। আমাদের চারপাশে, কত মানুষ- অহরহ জ্বলতে জ্বলতে, ক্লান্ত হয়ে পশ্চিম আকাশে ডুবে যাচ্ছে। কারও মুখে তখনও সোনালী হাসি, কারও মুখে তখন রাতের ঘন অন্ধকার। এই হলো মানসিক অবসাদ (DEPRESSION) ।

ক্লান্তি সবারই হয় গো, ক্লান্তি সবারই হয়। কিন্তু কোন কোন ক্লান্তি- জীবনের ভেতরে জ্বলতে থাকা, আশার প্রদীপটা এক্কেবারে নিভিয়ে দেয়। জ্বললে তুমি পুড়বেই। পুড়লে তুমি ছাই হবেই। বারবার যদি তুমি ছাই হতে থাকো, তাহলে তোমার মধ্যে জ্বলতে থাকা, আশার প্রদীপটাও নিভে যাবে। এই ছাই হয়ে যাওয়া হলো মানসিক অবসাদ। আর মানসিক অবসাদের বিরুদ্ধে যা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখে, তা হলো- তোমার আশার প্রদীপ।

মানুষ কি আরও- বেশী বেশী, উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে? হ্যাঁ। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম সবই কি- আরও বেশী বেশী, উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে? হ্যাঁ। তোমাদের কারও হিম্মৎ থাকে, আমার তথ্যকে খণ্ডন করো।

অবসাদগ্রস্ত কি শুধু মানুষ? মানুষের চেতনা নয়? মানুষের বিশ্বাস আর আশা নয়? মানুষের শিক্ষা নয়? মানুষের ধর্ম নয়? তুমি যখন অবসাদগ্রস্ত, তখন তুমি তোমার উপর ভরসা হারিয়ে ফেলো। আজকের শিক্ষা, সংস্কৃতি আর ধর্ম- শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েও, মানুষের মধ্যে শান্তি আনতে পারে নি। মানুষ তাই নিজেরই- শিক্ষা, সংস্কৃতি আর ধর্মের প্রতি ভরসা হারিয়ে ফেলেছে। তার কারন- আজকের শিক্ষা সংস্কৃতি আর ধর্ম- সবই অবসাদগ্রস্ত।

তুমি কি মূর্খ হে মানুষ, তুমি কি মূর্খ! তুমি জানো না, কতটা গাঢ় অন্ধকারে তুমি। পৃথিবীতে আঁধারটা কেমন যেন আরও ঘনীভূত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে- মানসিক অবসাদ (DEPRESSION) , আর উদ্বেগ (ANXIETY) । দশ বছরের বালক- স্কুলের ছাদ থেকে পড়ে আত্মহত্যা করছে। এগারো বছরের বালিকা- সালোয়ারের ওড়না, গলায় জড়িয়ে আত্মহত্যা করছে। সত্তর বছরের বৃদ্ধ বাবা, বাড়িতে একাকী পরিত্যক্ত হয়ে- বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করছে।

করছে করছে। এতো ভেবে লাভ কি? যার ফাটছে, তার ফাটছে। আমার না ফাটলেই হলো! তোমারও ফাটবে গো, তোমারও ফাটবে। বেশ চড়চড় করে, আর্তনাদ করেই ফাটবে! অন্যের ফাটতে দেখে, তোমার যেমন কোন করুণা হয় নি; ভবিষ্যতে তোমার যখন ফাটবে- তখন তাদেরও করুণা হবে না।

দেখো দেখো- দয়া, মায়া প্রেমও আজ কত অবসাদগ্রস্ত! এরাও কত ভাবলেশহীন, নিষ্ঠুর আর চেতনাহীন। শুধু বোমা-ই কি মানুষ মারতে পারে? শুধু ক্যান্সার-ই কি মানুষ মারতে পারে? মানসিক অবসাদ পারে না? মানসিক উদ্বেগ পারে না?

মানুষের এই অবসাদের যন্ত্রণা বাড়ছে কেন? এক কথায় তার উত্তর হলো- মানুষের নির্লজ্জ স্বার্থপরতা। মানুষ সকলের কাছ থেকে পাওয়ার সময়, সমাজবদ্ধ হতে চায়। কিন্তু দেওয়ার কথা উঠলেই, সে কেমন একাকী থাকতে চায়। এই অবাস্তব, বিপরীতমুখী চাওয়া-পাওয়ার কারনেই মানুষের আজকের যত যন্ত্রণা। শহরের বাবুরা- গ্রামের কৃষকদের থেকে, খাদ্যও নেবে; আবার তাদরেকে 'সংস্কৃতিহীন' বলে খিস্তিও করবে। পুরুষরা- নারী গর্ভে জন্মও নেবে, আবার সেই নারীকে ধর্ষণও করবে। আজকের বাড়ির বৌ-য়েরা- কাজের জন্য শ্বশুর শ্বাশুড়ির উপর ভরসাও করবে; আবার তাদেরকে অকথ্য অত্যাচারও করবে। অফিসের বাবুরা মাইনেও নেবে, আবার কাজ না করে, সরকারকে গালিও করবে।

মানুষ আজকাল শুধু পেতে জানে, দিতে জানে না। এই স্বার্থপরতা, লোভ, আর নৃশংসতা- পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে ভর করে, আমাদের দেশে হুহু করে বাড়ছে।

লোভ বাড়লে, স্বার্থপরতা বাড়ে। স্বার্থপরতা বাড়লে হিংসা-বিদ্বেষ বাড়ে। হিংসা-বিদ্বেষ বাড়লে, মনের মধ্যে জ্বলন বাড়ে। মনের মধ্যে জ্বলন হলে- তুমি তো পুড়বেই। পুড়লে তুমি তো ছাই হবেই। মানসিক অবসাদ কি, তোমার এমনি এমনি শত্রু হয়ে গেলো? তুমি কি তাকে ডেকে আনো নি?

বিষ খেলে যেমন শরীরের মৃত্যু হয়; ঠিক তেমনি- হিংসা, বিদ্বেষ আর লোভ সেবন করলে - তোমার মানসিক শান্তির মৃত্যু হয়। জেনে বুঝে তুমি যদি বিষ পান করো, তোমার মৃত্যু তো হবেই। আজকের শিক্ষা আর সংস্কৃতি শুধু নিতে শেখায়, দিতে শেখায় না। আজ মানুষের তাই- ধন আছে, সুখ নেই। নধর পুষ্ট কলেবর আছে, হৃদয় নেই। সুন্দর চকচকে দাঁত আছে, হাসি নেই। জীবনে পরমায়ু আছে, পরমায়ুতে শান্তি নেই। তাই মানুষের এতো 'আছে'র মধ্যেও, এতো 'নেই'। এতো পূর্ণতার মধ্যেও, এতো খাঁ খাঁ শূন্যতা। এতো উপচে পড়া মেকি হাসির মধ্যেও, এতো হুঁ হুঁ হাহাকার আর আর্তনাদ।

কি খোঁজো হে মানুষ, কি খোঁজো তুমি? তুমি ধন চাও, অথবা সুখ চাও? তুমি ঐশ্বর্য্য চাও, অথবা প্রশান্তি চাও? তুমি আতর মাখা প্রেয়সীর উঁচু উঁচু বুক চাও, অথবা প্রেমের কোমল স্পর্শ চাও?

এতো ভাবতে আমার বয়েই গেছে। আমি যেমন করছি, ঠিক তেমনি করবো। বেশ করবো- আমি চুরি করবো, তহবিল তছরুপ করবো; আর তারপর একদিন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করবো! আমি মরলে, তোমার বাপের কি শুনি?
(চলতে থাকবে।)

© অরুণ মাজী
Painting by John william Goodward

মানুষের হাতে বিষের কৌটা, এক উলঙ্গ উন্মাদ হা হা করে হাসছে।
Wednesday, April 5, 2017
Topic(s) of this poem: anxiety,bangla,bangladesh,depression
COMMENTS OF THE POEM
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Close
Error Success