মানুষ তো মরবেই। তাহলে অমরত্ব বলে সত্যিই কি কিছু আছে? আমি এখনো, এমন কাউকে দেখিনি যে- স্বর্গের অমরত্ব পেয়েছে। কিন্তু মাটির পৃথিবীর অমরত্ব, আমি অনেক দেখেছি। আমি এমন অমর মানুষ জানি- যাদের কথা স্মরণ করলেই, বুকের মধ্যে কেমন যেন আগুন জ্বলে উঠে। যাদের কথা স্মরণ করলেই, ঘোর আঁধারের দিনেও মনে হয়- আঁধার-ই শেষ কথা নয়! আবার ভোর আসবে। আবার পাখি ডাকবে। আবার এক নতুন দিন আসবে।
সেই মানুষটা মাটিতে নেই; কিন্তু বাতাসে আছে, আকাশের রামধনুতে আছে, পাখির কূজনে আছে। তুমি আমি- সকলেই জানি- সেই সব অমর মানবের কথা। সুভাষ বসু, বিবেকানন্দ- এরা হলেন সেই অমর মানব। কখনো ভেবে দেখেছো- কি সেই জিনিস, যা এদেরকে অমর করেছে?
তোমরা বলবে- বিদ্যা, বুদ্ধি, প্রতিভা ইত্যাদি। তোমরা জানো- আমি প্রায়ই বলি, প্রতিভার মতো মামুলি জিনিস আর হয় না। মামুলি কেন? কারন- পৃথিবীতে প্রতিভার ছড়াছড়ি। সত্যি বলতে কি- সব মানুষেরই কিছু না কিছু প্রতিভা আছে। তবুও তারা সকলেই সূর্যের মতো জ্বলে উঠতে পারে না। কেবল হাতে গুনা কয়েকজন সূর্যের মতো জ্বলে উঠে। এমন কেন হয়?
মহাভারতের কর্ণ চরিত্র কেন তোমাকে এতো আকর্ষণ করে? তিনি তো পরাজিত হয়েছিলেন! ট্রয়ের যুদ্ধের- হেক্টর চরিত্র কেন তোমাকে এতো আকর্ষণ করে? তিনি তো পরাজিত হয়েছিলেন! আমাদের ইতিহাসের, পুরু চরিত্র কেন তোমাকে এতো আকর্ষণ করে? তিনিও তো হেরেছিলেন। আমাদের সুভাষ বসুর চরিত্র কেন তোমাকে এতো আকর্ষণ করে? তিনিও তো হার মেনেছিলেন।
এরা পরাজিত হয়েও কেমন অমর আর অক্ষয়! জেতাটাই বিশালত্ব বা মহত্বের লক্ষণ নয়। তাহলে বিশালত্বের চাবি কাঠি কি?
আকিলিস- ট্রয় দেশের সাগর পারে, তার সৈন্য নিয়ে উপস্থিত। তারা দেখছে- ট্রয়ের বিশাল সৈন্য বাহিনী তাদের ছোট সৈন্য বাহিনীকে কচু কাটা করার জন্য, উঁচু জমিতে সেজে গুঁজে তৈরী রয়েছে। আকিলিসের সৈন্য বাহিনীর মনোবল- চূর্ণ। আকিলিস তখন তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলছে-
'দেখছো ওই উঁচু জমিটা? ওর- ওপারে রয়েছে তোমার অমরত্ব। যাও আমার বীর সৈন্য, তোমরা তোমাদের অমরত্ব ছিনিয়ে নাও।' একটু আগে, যে সৈন্যরা ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলো- তারা হৈ হৈ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
তুমিও অমর হতে পারো। কিভাবে? তুমি আর তোমার অমরত্বের মাঝে রয়েছে- একটা শক্ত দেওয়াল। সেটা কিন্তু ইঁট বা পাথরের দেওয়াল নয়। সেটা এক অদৃশ্য শক্তি, যা তোমাকে একজন মামুলি- ইঁদুর বা ছাড়পোকা বানিয়ে রেখেছে। কি সেটা? ভয়!
যারা তাদের জীবনে ভয়কে জয় করতে পারে, তারাই অমরত্ব লাভ করে। আমি যখন কার্গিল যুদ্ধের সময়, কাশ্মীরে গেলাম- তখন আমার ইউনিটে যাওয়ার রাস্তাতে, দুম করে একটা কামানের গোলা পড়লো। আমি তো ভয়ে শুকিয়ে কাঠ! গাড়োয়ালি সিপাই ড্রাইভার আমায় বললো- 'সাহাব, ঘাবড়ানা মত, জিন্দেগী মে মরণা হ্যায়- তো জিতে জিতে মরণা, গুন গুনাতে মরণা। হামলোগকো- চুহে কি তরা নেহি মরণা, সাহাব।'
আমার- ভয়কে জয় করার হাতেখড়ি, এক গাড়োয়ালি সিপাইয়ের হাত ধরে। জীবন কি সুন্দর গো, জীবন কি সুন্দর! জীবন প্রতি পদক্ষেপে, তোমার জন্য ফুল ছড়িয়ে রেখেছে- তোমাকে অমরত্ব দেবে বলে। তোমাকে শুধু জেগে উঠতে হবে। আরাম করে, পাশ ফিরে শুলে হবে না। ভয়কে জয় করার, সেই আমার শুরু। তারপর আমি পৃথিবীর বহুদেশে, অসংখ্য, ভয়াবহ সব যুদ্ধক্ষেত্রে গেছি। হাজার হাজার বুলেট (গুলি) - আমার কান ঘেঁষে, শোঁ শোঁ শব্দ করে বেড়িয়ে গেছে। আমি তবুও মরি নি। মরণ শুধু ভাগ্যবানদের কপালে জুটে। আমার মতো ডানপিটে, পাপী, ছোটলোকেদের কপালে এতো সহজে মরণ জুটে না।
বিদ্যা, বুদ্ধি, প্রতিভা- সবই মামুলি। এইসব দিয়ে কেউ কর্ণ বা সুভাষ বসু হয় না। এইসব দিয়ে কেউ- আকিলিস বা হেক্টর হয় না। পন্ডিত আর ইঁদুর সমার্থক। কারন- দুজনেই মরণশীল। ধনী আর ছাড়পোকা সমার্থক। কারন- দুজনেই মরণশীল। এরা আজ মরলে, কাল দু-দিন। কিন্তু তোমার বুকে যদি, সিংহের সাহস থাকে, তাহলেই তুমি অমর।
আজকের মানুষরা কেমন যেন কেঁচো, ইঁদুর, আর ছাড়পোকা। পিঠে কোন মেরুদন্ড নেই, বুকে কোন কলিজা নেই। এরা এক বাটি ফ্যানের জন্য- রাস্তার ফেতি কুত্তার মতো, লেজ নেড়ে নেড়ে, অন্যের পা আর পাছা চাঁটতে থাকে। না আছে- এদের ত্যাগ, না আছে এদের সাহস। তোমরা জানো- আমি প্রায়ই কর্কশ কথা বলি। সেগুলো মানুষকে হেয় করার জন্য নয়। সেগুলো মানুষের বুকে আগুন জ্বালানোর জন্য। নিজেকে তোমরা কখনো প্রশ্ন করেছো- তুমি মানুষ কেন? তুমি ইঁদুর নও কেন? যদি এখনো না করে থাকো, তো এখন তা করো।
তোমরা যদি মানুষের মতো, মানুষ হতে চাও; তাহলে তোমরা- সামান্য একটু স্বার্থের জন্য, অন্যের পা চাঁটা বন্ধ করো। বীর হও হে ভাই, বীর হও। সিংহ হও, ইঁদুরবাচ্চা নয়। বুকের পকেটে, দুটো ছবি রাখো- একটা সুভাষ বসু, আর একটা বিবেকানন্দের। যখনই ভয় পাবে- এই ছবি দুটো বুকে চেপে ধরবে। আর মনে মনে বলবে- আমি সিংহ শাবক, আমি ইঁদুর বাচ্চা নই।
আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি, তুমি অমর হবেই।
© অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem