ধরো, একটা পাতা জানে না, সে গাছের অংশ! বা একটা আঙুল জানে না, সে গোটা একটা মানুষের অংশ। তাহলে কি হবে?
আঙুলটা ভাববে সে স্বাধীন। তাই সে, তার মতো করো নাচতে চাইবে। কিন্তু সে পারবে কি? পারবে না। কেন? তার এক প্রান্ত হাতের সাথে গাঁথা।
আঙুলের ভেতর শিরা ধমনী স্নায়ু, সবই আসে মানুষের কাছ থেকে। আঙুল ভাবতেই পারে, সে নিজে নিজে নড়ছে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা কি তাই? না। মানুষের মস্তিস্ক, আঙুলের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করছে।
ধরো, একটা মানুষ জানে না- সে দেশের অংশ। তাহলে কি হবে? মানুষটা ভাববে সে স্বাধীন। তাই সে, তার মতো করে দু হাত তুলে নাচতে চাইবে। কিন্তু সে পারবে কি? পারবে না। কেন? সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, আর তার নিজস্ব জৈবিক চাহিদা ইত্যাদি দিয়ে, সে দেশের সাথে যুক্ত। তবুও সে ভাবে- সে একা, সে স্বাধীন! কি সাংঘাতিক উন্মাদ এই প্রলাপ! তাই না?
ক্ষুধা, আনন্দ, আবেগ- সব কিছুর জন্যই এক মানুষ, অন্যের উপর নির্ভরশীল। ধরো, এই ভারত ভূখণ্ডে আর কেউ নেই। মানুষ হিসেবে তুমি একা। কতদিন বাঁচতে পারবে তুমি? এক মাস? এক বছর? নাহঃ একমাসও তুমি পারবে না। সপ্তাহ শেষে তুমি আত্মহত্যা করবে। ব্যাপারটা যতটা সোজা ভাবছো, ততটা নয়। যে মুহূর্তে তুমি দেখবে পৃথিবী মানব শূন্য, সেই মুহূর্তেই তুমি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে।
আমরা যদি- একে অপরের সাথে, এতো গভীর ভাবে যুক্ত; তাহলে আমাদের মধ্যে এতো ঘৃণা, হিংসা আর মারামারি কেন? কেন তুমি আমি উভয়েই জিততে পারি না? কেন কেবল একজনকে জিততে, আর অন্যজনকে হারতে হবে?
যা বলছিলাম- আঙুল ততদিন বেঁচে থাকে, যতদিন সে মানুষটা বেঁচে থাকে। মানুষ ততদিন স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, যতদিন তার দেশ স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে। দেশের অস্তিত্বের উপর মানুষটার অস্তিত্ব নির্ভরশীল।
একজন যোগ্য মানুষ হিসেবে, তোমাকে তাই- তোমার নিজের দেশকে ভালো করে বুঝতে হবে, তাকে গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করতে হবে। বিশেষ করে, তোমার আপন দেশের ইতিহাস, আর সংস্কৃতি তোমাকে ভালো করে বুঝতে হবে। তোমার দেশকে ভালোবাসার অর্থ কিন্তু অন্যের দেশকে ঘৃণা করা নয়। যেমন তোমার মাকে ভালোবাসার অর্থ, অন্যের মাকে ঘৃণা করা নয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে- আজকাল কনভেন্ট এডুকেটেড এক শ্রেণীর মানুষ গজিয়েছে, যারা নিজেদেরকে এলিট লিবারেল বলে দাবি করে। তাদের কাজ হলো- ভারতবর্ষের ধর্ম, সংস্কৃতিকে ইত্যাদিকে রাত দিন গালমন্দ করা। অথচ, এদেরকে জিজ্ঞেস করো- যে ভারতীয় সংস্কৃতিকে তুমি গালমন্দ করছো, সেই ভারতীয় সংস্কৃতি জিনিসটা কি? আমি নিশ্চিৎ- তারা এর সঠিক উত্তর দিতে পারবে না। কেন?
এর উত্তর রয়েছে, এদের বেড়ে উঠার মধ্যে। এরা কনভেন্ট স্কুলে বিদেশী সংস্কৃতি শেখে, কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি শেখে না। আর এদের বাবা-মা, "বাচ্চাদের ভারতীয় সংস্কৃতি না জানাটাকে" খুব গর্বের মনে করে। এদের বাবা-মা আত্মীয় পরিজনের কাছে বলে বেড়ায়- "জানিস মুনমুন, আমাদের পিকলু- কেবল শেক্সপিয়ার আর শেলী পড়ে, নজরুলের নামই কখনো শোনে নি। কেন হবে না বল? আমাদের কবিদের যা ক্যাবলা ক্যাবলা লেখা! " সেই মাকে জিজ্ঞেস করো- তুমি নজরুলের কোন কবিতাটা পড়েছো? হয়তো কবিতার নামটাও উনি বলতে পারবেন না!
উপরের কথাটা কিন্তু একটুও অতিরঞ্জিত নয়। আমি নিজের কানে তা বারবার শুনেছি। কলকতায় এলে, আমি গামছা কাঁধে, লুঙ্গি পরে ঘুড়ে বেড়াই। লোকে আমাকে মেথর বা রিক্সাওয়ালা ভাবে। তাই তারা তাদের রংচঙা কোন আলোচনা, আমাকে দেখে থামায় না। কলকাতাতে আমি অল্প কয়েকদিন থাকলেও, আমার বেশ ভালোই কলকাতা দর্শন হয়ে যায়।
শুধু কলকাতা নয়। এই বাস্তব ভারতের সর্ব্বত্র। কোন জিনিসকে সমালোচনা তুমি করতেই পারো। কিন্তু সেই জিনিস সম্পর্কে একদম কিছু না জেনেই, তাকে সমালোচনা করা গর্হিত অপরাধ। ভারতীয় সংস্কৃতির কিছু না জেনেই, তুমি কি করে ভারতীয় সংস্কৃতিকে ঘৃণা করো? এইসব এঁচড়ে পাকা মানুষগুলো আবার, নিজেদেরকে লিবারেল বলে পরিচয় দেয়! লিবারেল শব্দের মানে জানে এরা?
কনভেন্টে শিক্ষা ভীষণই উপযোগী। আমি এর পূর্ণ সমর্থন করি। কিন্তু আগে তোমাকে, তোমার নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি আর ইতিহাস জানতে হবে। কোন মানুষই নিজের উৎসকে ঘৃণা করে বড় হতে পারবে না। এই ধরনের শিশুরা বড় হলে, হীনমন্যতায় ভুগে। তারা সহজেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
ভারতীয়দের এই হীনমন্যতার উৎস কি? এর উৎস হলো- ইংরেজ প্রভুদের দাসত্ববৃত্তি। আজকের অনেক ভারতীয়, হাভার্ড বা স্ট্যানফোর্ডে শিক্ষা লাভ করেছে, কিন্তু তাদেরও এখনো দাসত্ব বৃত্তির অভ্যাস যায় নি? নইলে কেমন করে তুমি ব্যাখ্যা করবে, যে ভারতীয়রা ইংরেজদের শাসন মেনে নেয় নি, সেই ভারতীয়রা নেহেরু পরিবারের শাসন যুগ যুগ ধরে মেনে আসছে? আমাদের দাসত্ব মানসিকতা ছাড়া, তুমি এটা কিভাবে ব্যাখ্যা করবে? পা আর পাছা চাঁটার অভ্যাস, আমাদের শিরায় শিরায়। তাই নেতা দেখলেই, আমরা তেলের বালতি নিয়ে তার পিছন পিছন ঘুরি। আমরা মানুষ না কৃমি? আমরা সবজি ভোজী না বিষ্ঠাভোজী?
সবচেয়ে প্রহসন কি জানো? আজকের শিক্ষিত লিবারেলরা নেহেরু পরিবারের দাসত্ব নিয়ে কোন আলোচনা করতে চায় না। কিন্তু একজন চাওয়ালা দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে, এরা গেলো গেলো রব তুলে তেড়ে আসে! এই নাকি এদের লিবারেল মানসিকতার নমুনা! লিবারেল হতে হলে, নিজেকে আগে সংস্কার মুক্ত হতে হয়। কিন্তু আজকের শিক্ষিত এলিটরাই তো বেশি সংস্কারে আচ্ছন্ন!
একটা দেশ তার উত্তরণের জন্য তার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উপর নির্ভর করে। কিন্তু আজকের শিক্ষিত সম্প্রদায়ই তো স্বার্থ আর গোঁড়ামির মাদকে বেশি আচ্ছন্ন। এরাই তো স্বার্থের জন্য ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়ায়। এরাই তো দেশের রাজার বিষ্ঠাভোজন শেষে, টিভিতে রঙ মেখে সঙ সেজে মানবিকতা আর ধর্ম নিরপেক্ষতার মিথ্যে বুলি আওড়ায়।
হে আমার প্রিয় ভাইরা, তোমরা নিজেকে শ্রদ্ধা করতে শেখো। অন্যের পা আর পাছা চাঁটা বন্ধ করো। কথায় কথায় "সরি" বলার অভ্যাস বন্ধ করো। যদি কিছু বলতে চাও, তা সাহসের সাথে বলো। এবং তোমার মতামতে দৃঢ় থাকো। সরি তখনই বলবে- তুমি যদি বুঝতে পারো, তুমি ভুল বলেছো। অমেরুদন্ডী হওয়া, আর বিনয়ী হওয়া এক জিনিস নয়। আমি বিনয়ী। কিন্তু আমার সঙ্গে কেউ পাঞ্জা লড়তে এলে, আমি তার আন্ডারপ্যান্টে বিষাক্ত কেউটে ছেড়ে দেবো।
কাকে ভয় করবে? তুমি মানুষ, অমৃতের সন্তান। তোমার কাকে ভয়? এমন ক্ষমতা রাখো, কোন ভুল দেখলে, তুমি যেন দেশের রাজার আন্ডারপ্যান্টে, বিষাক্ত পিঁপড়ে ছেড়ে দিতে পারো।
© অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem