Paul Verlaine Poems Translated In Bengali Poem by Malay Roy Choudhury

Paul Verlaine Poems Translated In Bengali

পল ভেরলেন-এর পঁচিশটি কবিতা
গদ্যানুবাদ: মলয় রায়চৌধুরী


পদত্যাগ
যখন ছোটো ছিলুম, কোহিনুরের স্বপ্ন দেখতুম,
পারস্য আর পোপের ধনসম্পতি, মহার্ঘ,
সম্রাট হেলিওগাবালুস, রাজা সারদানাপালুস!
আমার ভাবনা ভরে যেতো, যেখানে সোনার ছাদ উঠে যায়,
সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায়, যেখানে সুগন্ধ ফাঁদ পেতে ধরে,
অসংখ্য হারেম, দেহের স্বর্গোদ্যান!
এখন মন শান্ত তবুও কম আকুল নয়,
জীবনকে জানার পর, একজনকে কেমন বাধ্য হতে হয়,
অমন মনোরম বোকামিকে সামলাতে বলা হয়েছে আমায়,
আর তবুও খুব বেশি ছাড় দেওয়া যাবে না ।
তবে তাই হোক, সদিচ্ছাকে যদি মহানতা এড়িয়ে যায়,
তবু সাধারণ আর শিষ্টের স্তরে গিয়ে নামতে হবে!
কেবল সুন্দরী বলে আমি চিরকাল সে-নারীকে ঘৃণা করেছি
ছন্দ যা স্বরসাদৃশ্যে ভরা, বন্ধু যে বিচক্ষণ!
কখনও বেশি নয়
স্মৃতি, স্মৃতি আমার কাছে কি তুমি চাও? হেমন্ত
রঙহীন বাতাসের ভেতর দিয়ে গায়ক পাখিকে উড়াল দ্যায়,
আর সূর্য তার একেঘেয়ে রশ্মি ছড়ায়
হলুদ-হয়ে-আসা বনানীতে যেখানে গান গায় উত্তরের হাওয়া ।
আমরা ছিলুম একা, আর চলাফেরা করছিলুম স্বপ্নে,
মেয়েটি আর আমি, বাতাসে বিপর্যস্ত চুল আর চিন্তা ।
তারপর, নিজের দুশ্চিন্তিত চাউনি আমার দিকে মেলে,
‘তোমার সবচেয়ে ভালো দিন? ' ওর সোনালি কন্ঠস্বরে,
ওর কথা, দেবদূতের সুরে, তরতাজা, স্পন্দিত, মিষ্টি ।
আমি উত্তর দিলুম ওকে, বেশ বিবেচক মৃদু হাসি,
আর ওর শাদা হাতে অর্চকের চুমু রাখলুম ।
-আহ! প্রথম ফুলগুলো, কতো তাদের সুবাস!
আর কতো কমনীয় আবেগের গুঞ্জন
যে ঠোঁট ভালোবাসি তার প্রথম পাওয়া ‘হ্যাঁ!
তিন বছর পর
সরু নড়বড়ে গেট খুলে,
আমি পায়চারির জন্য গেলুম ছোট্ট বাগানে,
উজ্বল হয়ে উঠেছে সকালের সহৃদয় রোদে,
জলীয় আলোয় নক্ষত্র করে তুলেছে প্রতিটি ফুলকে ।
বদলায়নি কিছুই । আবার: নম্র কুঞ্জবন
বুনো লতাপাতায় আর দড়ি দিয়ে তৈরি চেয়ার…
ফোয়ারা সেই একইরকম রুপালি নকশায়,
আর শাশ্বত কাঁপুনিভরা বুড়ো পপলার গাছ ।
তখনকার মতো এখনও গোলাপেরা দুলছিল, আর তখনকার মতো
বাতাসে ঢুলছিল দীর্ঘাঙ্গী লিলিফুলের দল ।
সেখানের ভরতপাখিদের আমি চিনতুম, যাওয়া আসা বজায় রেখেছে ।
খুঁজে পেলুম জার্মান মহিলা সন্ত ভাদেলার মূর্তি তখনও দাঁড়িয়ে,
পথের শেষে পলেস্তারা খসে পড়ছে,
সময়ের ক্ষয়ে, সবুজাভ ফুলের স্নিগ্ধ সুবাসের মাঝে ।
ইচ্ছা
আহ! অনুরাগী কথা! আর প্রথম রক্ষিতারা!
চুলের সোনা, চোখের নীল, মাংসের কুসুম,
তারপর, প্রিয় দেহের ফাঁদের সুগন্ধে
আদরের লাজুক ফুর্তি!
এখন সেইসব লঘিমা থেকে কতো দূরে
আর সেইসব সরলতা! আহ, তবুও পেছন পানে,
কালো শীত থেকে চলে গেছে, পরিতাপের বসন্তঋতুতে,
আমার বিষাদ, আমার ক্লান্তি, আমার দুর্দশা থেকে ।
তাই আমি এখন একা, এইখানে, দুঃখি ও নিঃসঙ্গ,
দুঃখি আর হতাশ, বুড়োদের মতো ভয়ে চমকিত,
যেন বড়ো দিদি নেই এমনই দরিদ্র অনাথ ।
ভালোবাসে এমন নারীর জন্য, কোমল ও ধীর,
মিষ্টি, ভাবুক, শ্যামলী, আর সারাক্ষণ অবাক,
যে তোমার ভ্রূযুগলে একজন খুকির মতো যখন-তখন চুমু খায় ।
অবসাদ
(‘For the wars of love a field of feathers', Gangora)
মাধুরী মিশিয়ে, মাধুরী মিশিয়ে, মাধুরী মিশিয়ে!
আমার সন্মোহিনী,একটু শান্ত করো এই জ্বরের বিদার ।
একজন প্রেমী, অনেক সময়ে, তুমি জানো, এমনকি তার মহিমায়
একটি দিদিরচুপচাপবিস্মৃতির অভ্যাস চায় ।
ধীরুজ হও: তোমার আদরগুলো এনে দিক ঘুম,
তোমার দোলনা-দোলানো চাউনি আর দীর্ঘশ্বাসের মতন ।
আহ, জড়িয়ে ধরার ঈর্ষা, বড়োবেশি অঙ্গগ্রহ,
এক গভীর চুমুর মতো নয়, এমনকি মিথ্যা চুমুরও!
কিন্তু তুমি আমাকে বলো, খুকি: সোনায় গড়া তোমার হৃদয়ে
আরণ্যক ইচ্ছারা ক্রন্দন ছড়ায় ।
মেয়েটিকে হইচই করতে দাও, ও বড়োই সাহসী!
তোমার ভ্রূযুগল আমার ভ্রুযুগলে রাখো, তোমার হাত আমার হাতে,
প্রতিজ্ঞা করো সেইসব যা তুমি একে -একে ভেঙে ফেলতে চাও,
ভোর অব্দি কাঁদবো দুজনে, আমার ছোট্ট জ্বলাময়ী!

আমার অন্তরঙ্গ স্বপ্ন
প্রায়ই এই স্বপ্ন দেখি আমি, অদ্ভুত, অন্তর্দৃষ্টিতে গভীর,
সে এক নারীর, অজানা-অচেনা, যাকে ভালোবাসি, সেও আমায়,
আর যে প্রতিবার থাকেনাকো একইরকম,
একেবারে আলাদাও নয়: অথচ আমাকে চেনে, ভালোবাসে ।
ওহ কেমন করে চেনে সে আমাকে, আমার হৃদয়, জেগে ওঠে
স্পষ্ট তারই জন্য শুধু, তা তো কোনো সমস্যা নয়,
কেবল তারই জন্য: সেই শুধু বোঝে, তারপর
কেমন করে যে তার কান্না দিয়ে আমার ভুরুর ঘাম পুঁছি ।
সে কি শ্যামলী, শ্বেতাঙ্গিনী, নাকি পিঙ্গল? -জানিনাকো আমি ।
তার নাম? মনে আছে তা অতি স্পন্দমান আর প্রিয়,
যেন বা তাদের মতো জীবন নির্বাসিত করেছে যাদের ।
চোখ তার সেরকমই যেমন কোনো প্রতিমার চোখ,
আর তার কন্ঠস্বর, দূরাগত, সুগম্ভীর, মৃদু,
তার কন্ঠের স্বরাভাষ, যারা মারা গেছে ঠিক তাদের মতন ।
প্যারিসের দৃশ্য
চাঁদ তার দস্তার আবরণ খুলে ফেলছিল
অবিচ্ছিন্ন কোণাকুনিভাবে ।
ধোঁয়ার পালকগুলো পঞ্চমের মতো খুবই আলাদা
জোড়বাঁধা উঁচু ছাদ থেকে ঘন আর কালো উঠে যায় ।
আকাশ ধূসর ছিল, কাঁদছিল সে এক মৃদু হাওয়া
বাঁশের বাঁশির মতো ।
অনেকটা দূরে, হুলো-বিড়াল এক, চোরের মতন, চুপচাপ,
ডাক দেয়, ওহ, অদ্ভুত বেসুরো ।
আমি, হাঁটছিলুম, দিব্য প্ল্যাটোর স্বপ্ন
আর ফিদিয়ার,
সালামির, ম্যারাথন, ঝিলমিল-বোলানো নজরে
অজস্র চোখ, বাষ্পের নীলাভ চোখের উৎসারে।
এক রহস্যময় সন্ধ্যার গোধুলী
গোধুলীর দীপ্তিময় স্মৃতি
আর আগ্নেয় দিগন্তের কম্পন
জ্বলন্ত আশার যা গুটোয় আর বেড়ে যায়
কোনো রহশ্যময় পরদার মতো
যেখানে অমিতব্যয়ী ফুলেদের দল
-ডালিয়া, লিলি, টিউলিপ আর গ্যাঁদাফুল -
জাফরির চারিধারে ঘুরপাক খায়
মাতাল হাওয়ায়
পৃথু সৌরভের, যার উষ্ণতার বিষ
-ডালিয়া, লিলি, টিউলিপ আর গ্যাঁদাফুল -
আমার ইন্দ্রিয়, আত্মা আর যুক্তিবোধ বিহ্বল করে,
তাদের প্রগাঢ় বিভ্রমে টেনে নেয়
গোধুলীর দীপ্তিময় স্মৃতি ।
সন্ধ্যা
কুয়াশাছায়া দিগন্তে রক্তবর্ণ চাঁদ;
নৃত্যরত কুহেলিকায়, গোচারণভূমি
ধোঁয়ায় ঘুমোয়, নীচে ব্যাঙেদের দল
সবুজ নলবনে যেখানে শীতলতা বয়;
দরোজা বন্ধ করে নেয় লিলিফুল,
পপলার গাছেরা ছড়িয়েছে বহুদূর,
দীর্ঘ আর পাশাপাশি, তাদের অপচ্ছায়ারা খাপছাড়া;
জোনাকিরা ঝোপের ভেতরে শিখা জ্বালে;
পেঁচারা জেগে আছে, শব্দহীন তাদের উড়ালে
ভারি ডানা দিয়ে বাতাসে তারা দাঁড় বায়,
ভরে ওঠে সুবিন্দু, বিষণ্ণতায় দ্যুতিমান ।
পাণ্ডুর শুকতারা দেখা দ্যায়, আর রাত্রি নেমে আসে ।
পাপিয়া
পাখিদের উচ্চরব উড়ালের মতো, জটিল অন্ধকার,
আমার সমস্ত স্মৃতি আমাকে বিধ্বস্ত করে চলে,
হলুদ পাতাদের মাঝে দিয়ে নামে প্রহরণ
আমার হৃদয়ের অবনত ভূর্যগুঁড়িতে, তার দৃষ্টিপাত
অনুতাপের জলরাশিতে ছায় রুপালি অরূণ
যার বিষাদময়তা এখনও স্রোতোস্বিনী,
নামে প্রহরণ, আর তারপর অশুভ অনুচ্চস্বর
যাকে এক উড়ন্ত আদ্র বাতাস সেখানে থামায়,
পাতাদের মাঝে ক্রমে মারা যায়, তাই
মুহূর্তের মধ্যে তুমি শুনতে পাবে না কিছুই, ওহ,
অনুপস্হিতকে প্রশংসা করার স্বর থেকে বেশি কিছু নয়,
কন্ঠস্বরের থেকে বেশি কিছু নয় - ওহ, কাতরতা! -
পাখিটির, আমার প্রথম প্রেম, যা এখনও গান গায়
যেমন গাইতো গান বহুকাল আগেকার প্রথম সন্ধ্যায়;
আর চাঁদের বিষাদময়ী ঐশ্বর্যের নীচে
ম্লান একাকীত্বে জেগে ওঠে, জুনমাসের এক
রাত, অবসাদময়, গ্রীষ্মের চাপে দুর্বহ,
নৈঃশব্দ ও অন্ধকারে পরিপূর্ণ, নীলচে আলোয়
মৃদু বাতাস যাকে আলতো ছোঁয়, দোলায় তন্দ্রায়
সেই গাছটিকে যা কেঁপে-কেঁপে ওঠে, যে পাপিয়া ফুঁপিয়ে গান গায় ।
নারী ও বিড়াল
ওর বিড়ালকে নিয়ে খেলছিল মেয়েটি:
ভালো লাগছিল তাকে দেখে
শাদা হাত আর শাদা থাবা
সন্ধ্যার ছায়ায় খেলা করে ।
মেয়েটি লুকায় -ছোট্ট দুষ্টুর মতো! -
রেশমের কালো দস্তানাতে
খুনি মণিরত্ন-নখর,
বিড়াল-শিশুর মতো কোপন ও উজ্বল ।
অন্যজনও ছিল মধু-ওপচানো
আদরের তীক্ষ্ণনখ দস্তানা থেকে বের করে,
যদিও শয়তানটা এ-ব্যাপারে মন্দ ছিল না…
আর শোবার ঘরটিতে, সুরেলা যেখানে
স্বর্গীয় হাসিবাতাসে তুলছিল ঝংকার,
সেখানে ফসফরাসের চারটি বিন্দু ছিল দীপ্তিময় ।
শিল্পহীনদের গান
আমরা আসলে সবাই শিল্পহীন,
চুলেতে বিনুনি, দুই চোখ নীল,
গোচরতা থেকে যেন বা লুকিয়ে
উপন্যাসে পাওয়া যাবে না তাদের ।
আমরা হাঁটি, বাহুতে গলিয়ে বাহু,
আর দিনটি বিশুদ্ধ নয় আজ
যেমন আমাদের চিন্তার গভীরতা,
আর আমাদের নীলাভ স্বপ্ন ।
আর আমরা খেতের ভেতর দিয়ে দৌড়োই
আর আমরা হাসি আর আমরা গুলতানি করি,
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত,
আমরা প্রজাপতিদের ছায়ার পেছনে দৌড়োই:
আর মেষপালিকাদের শিরাবরণ
আমাদের তরতাজা রাখে
আর আমাদের পোশাক -ফিনফিনে -
নিখুঁত ধবধবে ।
ডন হুবানেরা, লোথারিওরা,
চেয়ে-দেখা রাজকুমারেরা,
আমাদের শ্রদ্ধা করে,
তাদের অভিনন্দন ও দীর্ঘশ্বাস:
যদিও লোকদেখানো, তাদের মুখবিকৃতি:
তারা নিজেদের নাকে আঘাত করে,
হাস্যকর আনন্দে
আমাদের বিলুপ্ত পোশাকে:
তবু আমাদের সরলতা
তাদের কল্পনাকে বিদ্রুপ করে
যারা হাওয়াকলের সঙ্গে লড়ে
যদিও অনেক সময়ে আমরা মনে করি
আমাদের হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হয়
চোরাগোপ্তা স্বপ্নে
এই কথা জেনে আমরাই ভবিষ্যতের
কামুকদের প্রেমিক ।
সান্ধ্য প্রেমসঙ্গীত
একজন মৃত মানুষের কন্ঠ হয়তো যেমন গান গাইবে
কবরের অতল থেকে,
আমার রক্ষিতা, সুরহীন আর কর্কশ, প্রতিধ্বনি করে
তোমার পানে, সে কন্ঠস্বর আমারই ।
তোমার আত্মাকে মেলে ধরো আর ধ্বনি শোনো
আমার ম্যান্ডোলিনের:
তোমার জন্য আমি এই গান লিখেছি, তোমার জন্য, খুঁজে পেয়েছি
এই নিষ্ঠুর, কোমল জিনিস ।
সমস্ত ছায়া থেকে বের করে এনে
আমি গাইবো তোমার সোনার আরস্ফটিকের চোখ,
তারপর তোমার বুকের লিথি, বৈতরণী
তোমার কালো চুলের নদীদের স্রোত ।
একজন মৃত মানুষের কন্ঠ হয়তো যেমন গান গাইবে
কবরের অতল থেকে
আমার রক্ষিতা, সুরহীন আর কর্কশ, প্রতিধ্বনি করে
তোমার পানে, সে কন্ঠস্বর আমারই ।
এরপর আমি গুণগান করব, সর্বোপরি
সেই আশীর্বাদপূত মাংসকে
যার বিলাসবহুল সুগন্ধ ডেকে আনে
অনিদ্রার বিপর্যয় ।
উপসংহার এই যে, আমি চুমুর কথা বলব
তোমার লাল ঠোঁটে,
আর আমার শহিদত্ব কেমন মিষ্টি,
- আমার দেবদূত! -আমার চাবুক!
তোমার আত্মাকে মেলে ধরো আর ধ্বনি শোনো
আমার ম্যাণ্ডোলিনের:
তোমার জন্য আমি এই গান লিখেছি, তোমার জন্য, খুঁজে পেয়েছি
এই নিষ্ঠুর, কোমল জিনিস ।
মূক অভিনয়
পিয়েরো, যিনি মোটেই ক্লিতান্দ্রের সমকক্ষ নন (মলিয়ের জানতেন)
কোনো হইচই না করেই বোতল খালি করে ফেলতেন,
আর, চিরকাল যেমন ব্যবহারিক, আরম্ভ করতেন ময়দা মাখা ।
কাসেনদার, গলিপথের শেষে,
দু-এক ফোঁটা চোখের জল ফেলতেন যা কেউ দেখতে পেতো না
ওনার ভাইপোর জন্য, আজকে যে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত ।
সেই বজ্জাত হারলেকুইন তো দেখেছে
কোলোমবাইনের অপহরণ
আর চার বার ঘুরপাক ।
কোলোমবাইন স্বপ্ন দ্যাখে, আমাদের মতোই অবাক
হাওয়ার ভেতরে হৃদয় রয়েছে অনুভব করে
আর শোনো, মেয়েটির হৃদয়ে, স্বরের ছন্দ তৈরি হয় ।
আমাদের চলাফেরা
আকাশ এতো ম্লান আর গাছেরা এমন তন্বী
মনে হয় আমাদের উজ্বল পোশাক দেখে হাসছে
যা হালকা ভাসমান, একটু বেশি
নিস্পৃহ, ভূকম্পনের মতন ডানা ।
আর পুকুরে বলিরেখা আঁকে মলিন বাতাস,
আর সূর্যের আলোও নরম হয়ে আসে
রাস্তার দুধারের লেবুগাছের ছায়া
আমাদের করে তোলে, যেমনটা চায়, মর্মভেদী, নীল ।
সূক্ষ্ম প্রতারকদল, কমনীয় ছিনালেরা
কোমল হৃদয়, কিন্তু প্রতিশ্রুতিহীন,
আমাদের সঙ্গে আনন্দে কথা বলো আর অভিবাদন করো,
সব প্রেমিক-প্রেমিকারা তাদের পোষা প্রাণীকে লাই দ্যায়,
একটা হাত অনিবদ্যভাবে টোকা দেবে
এখন বা পরে, অদলবদল করবে
একটা চুমুর জন্য কড়ে আঙুলকে রেখে
ঠোঁটের কোনায়, আর যেহেতু ব্যাপারটা
নিরতিশয় অতিরিক্ত এবং যথেষ্ট কোপন,
তার জন্য শাস্তি পায় শুকনো চাউনি দিয়ে,
যা ঘটায় বিষমতা, ঘটনাক্রমে, আলতো-খোলা ঠোঁট
ক্ষমাশীলতার নাটুকে মহলা চালায় ।
নিষ্পাপ মানুষেরা
দীর্ঘ পোশাকের সঙ্গে লড়েছে হিল-তোলা জুতো,
যাতে, মৃদুমন্দ হাওয়া আর উৎরাই প্রশ্ন তোলে,
কনুই কখনো-বা আমাদের মুগ্ধ করতে আভাসিত হয়,
আহ, কালহরণ! -প্রিয় মূর্খতা!
ঈর্ষান্বিত কীট হুল ফোটায় অনেকসময়ে
শাখার তলায় সুন্দরীদের বিক্ষুব্ধ গলা,
আচমকা ঝলকানিতে উঁকি দেয় শ্বেতাঙ্গিনী গ্রীবা
তোমার কচি-চোখের বুনো চাউনির উৎসব ।
সন্ধ্যা নামে, দ্বর্থ্যক হেমন্তের সন্ধ্যা:
সুন্দরীরা, স্বপ্নালিনীরা, যারা আমাদের কাঁধে হেলান দিয়েছে,
বলেছে ফিসফিসে শব্দ, কতো ছলাকলা, এমন কমনীয়,
আমাদের আত্মা রয়ে গেছে স্পন্দনে আর গানে-গানে ।
যুবতীর অনুচরগণ
জরিতে বিভূষিত একটি বাঁদর
খেলা দেখায় তিড়িং-বিড়িং নাচে কেননা মেয়েটি
যে ঘোরাচ্ছে রুমালের কিনার
কবজি পর্যন্ত দস্তানা পরা তার হাতে,
তখন এক কালো কেনা গোলাম লাল রঙের পোশাকে
দাঁড় করিয়ে রাখে গাড়ি, এক হাতের দূরত্বে,
মেয়েটির গুরুভার পোশাক, অভিপ্রায়
লক্ষ রাখার যাতে ভাঁজগুলো নষ্ট না হয় ।
বাঁদরটা কখনও চোখ সরায় না
যুবতীর নরম শাদা গলদেশ থেকে ।
প্রচুর ঐশ্বর্য যার বৈভবী টীকা
পুরস্কাররুপে কোনো দেবতার নগ্ন ধড় চায় ।
ক্রীতদাস কখনও-বা ওপরে ওঠাবে,
বজ্জাত, যতোটা সে চায় তার বেশি,
নিজের মহার্ঘ ভার, যাতে সে
রাতে যা স্বপ্নে দেখে তা-ই দেখতে পায়;
তবু মনে হয় যুবতীটি এখনও অবিদিত
যখন সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে
দাম্ভিক অনুমোদন কেমন দেখায়
তার পরিচিত প্রাণীর জ্বলন্ত চোখে ।
সমুদ্রের ঝিনুকগুলো
প্রতিটি ঝিনুক, আবরণে ঢাকা, আমরা দেখি,
যেখানে আমরা প্রেমের উদ্দেশ্য পূরণ করতে চেয়েছি সেই গুহায়,
তার নিজের বিশেষত্ব আছে ।
একটির আছে আত্মার বেগুনি রঙ,
আমাদের, রক্তের ডাকাত যা হৃদয়কে ভোগদখল করে
তখন আমি জ্বলি আর তুমি দাউদাউ করো, তপ্ত কয়লার মতো ।
ঐ আরেক যা তোমার অবসন্নতাকে প্রভাবিত করে,
তোমার বিবর্ণতা, তোমার ক্লান্ত গড়ন
আমার দৃষ্টিবিদ্রুপে ক্রুদ্ধ:
এই আরেকটা নকল করে স্নিগ্ধতা
তোমার কানের, আর এটা আমি দেখি
তোমার গোলাপি গ্রীবা, কতো সুডৌল আর উষ্ণ:
কিন্তু একটা, তাদের মধ্যে একটা, আমাকে ক্লিষ্ট করেছে ।
জড়পুতুলেরা
স্কারামোচে আর পুলসিনেলা,
দুষ্টুমি করার জন্য একত্রিত হল
অঙ্গভঙ্গী করে, কালো চাঁদের দিকে ।
তখন সবচেয়ে ভালো ডাক্তার
লোকটা বোলোনাবাসী, ধীরে জড়ো করে
ঘাসের গর্ভ থেকে যতো জড়িবুটি ।
কিন্তুকুটিল-চোখ ওর মেয়ে,
লুকিয়ে কূঞ্জবনে,
অর্ধেক উলঙ্গ, পিছলায়, খুঁজে ফেরে
নিজের স্পেনিয় জলদস্যুকে:
মিষ্টি গলার এক পাপিয়া
দুর্দশা ঘোষণা করে তার ।
জাহাজে
মেষপালকের নক্ষত্র, শিহরিত,
কাণ্ডারী, অন্ধকার জলে,
নিজের ট্রাউজারের ভেতরে চায় আগুন ।
এখনই সেই সময়, মহাশয়্গণ, কিংবা আর কখনও নয়,
বেপরোয়া হবার জন্য, আর তুমি আবিষ্কার করবে
আমার হাতগুলো, এখন থেকে, সর্বত্র!
রোমের পুরাণের আতিস, রাজকুমার, নিজের গিটারে
টুংটাং তোলে, শীতল মায়াবিনী ক্লোরিস
নজর মেলে দ্যাখে, আর তাও নচ্ছার ।
যাজক স্বীকৃতি শোনে সাপের রানি বেচারি এগলের,
আর সেই ভাইকাউন্ট, বিড়ম্বনায়,
ফসলখেতের রাজকুমার, নিজের হৃদয় বিলিয়ে দিয়েছে ।
ইতিমধ্যে চাঁদ ঝরিয়ে ফেলেছে নিজের দীপ্তি
জাহাজের তলাকার সংক্ষিপ্ত ধাবনে
মজায় নাচতে-নাচতে স্বপ্নালু স্রোতে ।
ফন: ছাগলের শিং ও লেজযুক্ত রোমের দেবতা
পোড়া মাটির এক প্রাচীন ফন
বল খেলার সবুজ মাঠে
হাসে, নিঃসন্দেহে সঙ্কেত দিয়ে,
এই সুন্দর সময়ের দুঃখি অবশেষ,
যা আমাকে আর তোমাকে নিয়ে চলেছে
অজর হতাশার তীর্থে,
এই সময়ে যার ফুরিয়ে যাওয়ার
ঘুর্ণিতে বেজে ওঠে তাম্বুরা ।
ম্যাণ্ডোলিন
সান্ধ্য প্রেমসঙ্গীতের বাদকেরা
আর তাদের সুসজ্জিত শ্রোতারা
বিরস মন্তব্য চালাচালি করে, গুঞ্জরিত
গাছের শাখার তলায় বসে ।
এখানে রয়েছে ট্রিসিস আর অমিনতা
আর শাশ্বত ক্লিতান্দের,
আর দামিস যে নিষ্ঠুরদের অনেকের
স্হান নেয়, বহু গান যা বেশ কমনীয় ।
রেশমের পোশাক ছোটো করে কাটা,
তাদের দীর্ঘ আলখাল্লার চাদর,
তাদের লালিত্য, খোশমেজাজ চাতুরি,
আর তাদের মোলায়েম নীল ছায়া,
ভাবাবেশে আবর্তিত হয়
গোলাপি ও ধূসর চাঁদ থেকে পাওয়া
যখন দমকা হাওয়ার ঝাপটায়
ম্যাণ্ডোলিনের ঝঙ্কার মিলিয়ে যেতে থাকে ।
কোলোমবাইন
মূর্খ লিয়েনডার,
পিয়েরোও লাফাচ্ছিল
মাছির মতন
আর বনে ঝাঁপ খাচ্ছিল,
টুপি-পরা কাসেনদার
মঠের সন্ন্যাসীর মতো,
আর তারপর সেই সঙ,
পাপের ধড়িবাজ
উদ্ভট,
পাগলের পোশাকে,
চোখ তার জ্বলছিল,
ঠাকতে পারেনি,
সা, রে, গা, মা, পা -
সবাই ছড়িয়ে আর দূরে
হাসতে হাসতে চলে গেল
মেয়েটির জন্য গাইতে-গাইতে, নাচতে-নাচতে
সেই ছোট্ট তোরণ
চমৎকার
চোখ যার লম্পট
সবুজ বা আরও খারাপ
বিড়ালের মতো,
ওর সৌন্দর্যে কাঁদো কেননা,
‘আহ, তোমার থাবা কোথায় রেখেছো
খেয়াল করো! '
-সবসময়যাবার জন্য ব্যস্ত!
নিয়তির নক্ষত্র যা ভেসে বেড়ায়
দ্রুত,
ওহ, বলো, সেই বিষয়ে
নিষ্ঠুর কিংবা অস্বস্তিকর লোকজন,
অভাবনীয় বিপর্যয়
এই নির্দয়ী ছিনাল,
আলতো করে স্কার্ট তোলে
তার দলবল,
মেয়েটির চুলে গোলাপ,
ওই দিকে এগিয়ে যায়,
মেয়েটির প্রতারণার শিকার?
কিউপিড নিপাতিত
গত রাতের বাতাস দেখলো কিউপিড নিপাতিত,
পার্কের সবচেয়ে রহস্যময় কোনে, কে
ছলনাময় হাসি হেসে নিজের ধনুক বেঁকাবে,
তার মুখভঙ্গী আমাদের তেমনই দিবাস্বপ্ন দেখতে বলছে!
গত রাতের বাতাস ওকে ঠেলে ফেলে দিলো! শ্বেতপাথর
ভোরের নিঃশ্বাসে চুরমার । দেখতে খারাপ লাগে
ওর বেদি, তাতে ভাস্করের নেম এক রহস্য,
কুঞ্জবনের ছায়ায় তা দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না ।
ওহ, ফাঁকা বেদিটা দেখে মন খারাপ হয়
পুরোটা খালি! আর বিষাদ ভাবছিল প্রবেশ করবে
আমার স্বপ্নে চলাফেরা করবে, যেখানে গভীর মর্মবেদনা
এক ভবিষ্যত-নিঃসঙ্গতা আর নিয়তিনির্দিষ্টতার ডাক পাড়ে ।
ওহ, এটা ভালো নয়! -আর তুমি তা অনুভব করো, হ্যাঁ, তুমিও,
দৃশ্য দিয়ে আবেগপীড়িত, যদিও তোমার ইতিউতি চোখ
সোনালী আর রক্তিম প্রজাপতির পুতুল নিয়ে খেলে
পথের ধারে ফেলে দেয়া জঞ্জালের গাদা ঘেঁটে ।
ভাবপ্রবণ কথোপকথন
পুরোনো ফাঁকা পার্কের জমাটবাঁধ কাচ দিয়ে
দুটি কালো ছায়া সম্প্রতি চলে গেলো ।
ওদের ঠোঁট ছিল ঢিলেঢালা, চোখ ছিল ঝাপসা,
শোনা যাচ্ছিল না ওরা কী যে বলছিল ।
পুরোনো ফাঁকা পার্কের জমাটবাঁধা কাচ দিয়ে
অতীতকে আহ্বান করল দুটি ভুতুড়ে আদল ।
‘তোমার কি মনে আছে আমাদের বিগত আহ্লাদ? '
‘কেন তুমি আমায় স্মৃতি খুঁড়ে আনতে বলছ? '
‘তোমার হৃদয় কি এখনও শুধু আমার নামে স্পন্দিত হয়? '
‘তুমি কি সব সময় আমার আত্মাকে স্বপ্নতে দ্যাখো? ' - ‘আহ, না' -।
‘ওহ সেই অবর্ণনীয় রহস্যময় সুন্দর দিনগুলো,
যখন আমাদের মুখের মিলন ঘটত! ' -‘আহ হ্যাঁ, সম্ভবত ।'
‘কতো নীল ছিল, আকাশ, কতো উঁচু আমাদের আশা! '
‘বিদায় নিয়েছে আশা, বিজয়ী, অন্ধকার ঢালে ।'
ওরা দুজনে সেখানে পায়চারি করছিল, বুনো জড়িবুটির মাঝে,
আর তাদের কথাবার্তা কেবল শুনছিল রাত ।

Friday, February 7, 2020
Topic(s) of this poem: symbolism
COMMENTS OF THE POEM
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Close
Error Success