চড়াই উৎরাই ১৭ (Trishna) Poem by Arun Maji

চড়াই উৎরাই ১৭ (Trishna)

এক সৈনিকের শ্মশান যাত্রার কাহিনী, কার্গিল যুদ্ধ অবলম্বনে অরুণ মাজীর উপন্যাস
---------------
খবরটা আগুনের মত ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। হাবিলদার নেগি মারা গেছেন। হাসপাতালে দীর্ঘ রোগ ভোগের পর।

কিন্তু হাবিলদার নেগির পরিবার খুব দরিদ্র। তার ছোট্ট একটা ছেলে। আর গৃহিনী  স্ত্রী। হাবিলদারকে দাহ করার মতো আর্থিক বা সামাজিক ক্ষমতা নেই তাদের।

সুবেদার মেজরের সাথে, পরামর্শ করলেন CO। ঠিক হলো, হাবিলদারের স্ত্রী আর পুত্রকে এখানে আনা হবে। তাদের অনুমতি নিয়ে, এখানেই দাহ করা হবে হাবিলদারকে।

ঠিক হলো, আগামী পরশু, ইউনিটের পিছনে যে জঙ্গলে ঢাকা ছোট নদী রয়েছে, সেই নদীর পারে, দাহ করা হবে তাকে।

মনে পড়ে গেলো কিছুদিন আগের কথা। হাবিলদার নেগি এসেছিলেন আমার কাছে। বেশ অসুস্থ। পেচ্ছাপের সাথে রক্ত। হাত পা মুখ ফোলা। সঙ্গে হাই ব্লাড প্রেসার। সন্দেহ করেছিলাম, একিউট গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস। কিন্তু সেই রোগ যে তার মৃত্যুর কারণ হবে, তা কখনো ভাবতে পারি নি।

সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম ওনাকে। বেশ কিছুদিন চিকিৎসাও চললো। কিন্তু অবশেষে, কিডনি ফেল করলো ওনার। মারা গেলেন উনি।  

কিছুদিন আগে যে মানুষটাকে দেখেছি, এখন পেলাম তার মৃত্যু সংবাদ! তাই বেশ বিচলিত বোধ করলাম উনি। যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে এসে, অন্য এক শত্রুর হাতে প্রাণ দিলেন উনি।  

মরণ মানুষকে হন্যে হয়ে তাড়া করছে। আজীবন। আমৃত্যু। দিনে। রাতে। তাই না? কেউ তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। না আমি। না তুমি।

দমকা একটু বাতাসে ধূলিকণা যেমন অদৃশ্য হয়ে যায় অদৃশ্য কোন স্থানে; তেমনি মানুষের জীবনও একদিন অদৃশ্য হয়ে যাবে অদৃশ্য কোন স্থানে। প্রাণের স্পন্দন অনুভব করি আমরা। কিন্তু প্রাণকে দেখতে আমরা পাই না।

হাবিলদার নেগির দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেলো। কোথায় গেলো? কোথায়? কে দেখেছে সেই প্রাণকে? কেউ দেখে নি।

রয়ে গেলো কেবল, হাবিলদার নেগির প্রাণহীন দেহ। এ দেহ তো হাবিলদার নেগি নয়। এ দেহ তো আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করবে না- 'কেমন আছেন ডাক্তার সাহেব? ' না, কোনদিন জিজ্ঞেস করবে না।

অবশেষে, এলো সেই মুহূর্ত।  চারিদিকে জঙ্গল। মাঝখানে ছোট্ট এক নদী। এত ছোট্ট এই নদী, যে গ্রাম বাংলায় তাকে নালা বলি আমরা। আসলে, নদীর উপত্যকা বেশ বড়। কিন্তু জলের প্রবাহ খুব সরু আর অগভীর। পুরো উপত্যকা জুড়ে রয়েছে ছোট বড় নুড়ি আর পাথর। বালি বা কাদা সেখানে খুব কম। পাহাড়ি অঞ্চলের নদীগুলো, ঠিক এমনই হয়।

নদীর এপারে সাজানো হলো চিতা।  সেই চিতার একদিকে হাবিলদার নেগীর প্রাণহীন দেহ। আর অন্যদিকে হাবিলদার নেগীর সদ্য বিধবা স্ত্রী।

হাবিলদার নেগির ছেলেটির বয়স, বছর পাঁচেক হবে। দেখলাম, ছেলেটি কেমন যেন নির্বিকার। মনে হলো, কিছুই বুঝতে পারছে না ও।

বোঝার কথাও নয়। বুড়োরা জানে না, মৃত্যু কি? তো একরত্তি ছোট্ট এই শিশু, তা বুঝবে কি করে?

দেখলাম, ছেলেটি হটাৎ চিতার কাছে দৌড়ে গেলো। চিতার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর, আবার ও পিছিয়ে এলো। তারপর ও, ওর বাবার কাছে গেলো। সাদা কাপড়ে ঢাকা ওর বাবা। ওর বাবার প্রাণহীন দেহের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো ও। কিন্তু কাঁদলো না। কোন কথাও বললো না। সত্যিই কেমন যেন  নির্বিকার ও।  

হটাৎই কেমন যেন ভয় পেলো ও। এবার ওর মায়ের কাছে দৌড়ে গেলো ও। ওর মায়ের কোলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। মা.....

ওকে বুকে জড়িয়ে, ওর মা চীৎকার করে কেঁদে উঠলো। সেই কান্না, প্রতিধ্বনিত হলো গাছের ডালে। নদীর পারে। আকাশে। বাতাসে। সেই সঙ্গে, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠলো গান স্যালুট। উপস্থিত সৈনিকের দল চীৎকার করে উঠলো-
'হাবিলদার নেগি অমর রহে'
গুড়ুম গুড়ুম গুড়ুম.......

হাবিলদার নেগিকে চিতাতে উঠানো হলো। ছোট্ট ছেলেটির হাতে মশাল ধরিয়ে দেওয়া হলো। জ্বলে উঠলো চিতা। ঠিক সেই মুহূর্তে আরও একবার গর্জে উঠলো রাইফেল।  গুড়ুম গুড়ুম গুড়ুম। গান স্যালুট। 'হাবিলদার নেগি অমর রহে।'

নিজেকে আর সংবরণ করতে পারলাম না। ছুটে গেলাম আমি। বুকে জড়িয়ে ধরলাম সেই ছোট্ট ছেলেটিকে। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই, চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো আমার। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আর এক চিতা। আমার বাবার চিতা।

পঁচিশ বছর আগে, এরই মত ছোট্ট ছিলাম আমি। এরই মত সেদিন, আমার বাবার চিতায় আগুন দিয়েছিলাম আমি। সময়ের প্রবাহ ঠিক এমনি করে মানুষের অতীত ফিরিয়ে আনে। চেতনা ফিরিয়ে আনে। স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। স্বপ্ন ফিরিয়ে আনে।

ঘামছি আমি। পা টলটল করছে আমার। এখুনি হয়তো পড়ে যাবো আমি। ছেলেটিকে বুকে নিয়ে, পাথরের উপর বসে পড়লাম আমি। আমার মাথার ব্যারে (আর্মি টুপি) খসে পড়লো মাটিতে। ইউনিফর্ম অগোছালো হয়ে গেলো আমার। CO আমার দিক আড়চোখে চেয়ে দেখলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।

সামনে তখন চিতা জ্বলছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে। সেই জাজ্বল্যমান চিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জ্বলে উঠলো, এক সদ্য বিধবা নারীর নিঃসঙ্গ বুকের হাহাকার। নৈঃশব্দের ভাষায় জেগে উঠলো এক শিশুর পিতাকে হারানোর হাহাকার। মরমের যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ করলাম আমি।

চোখ খুলে দেখি, ছেলেটা আমার ল্যানিয়ার্ড নিয়ে খেলছে। ওকে ল্যানিয়ার্ড নিয়ে খেলতে দেখে, আমার বাহু থেকে ল্যানিয়ার্ডটা খুলে দিয়ে দিলাম ওকে। CO আবার চেয়ে দেখলেন আমার দিকে। এবার উনি মৃদু হাসলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।  

ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় কোন সৈনিক কখনো ল্যানিয়ার্ড খুলে না। নিয়ম ভেঙেই আমি তা খুললাম।  সদ্য পিতৃহারা এক শিশুর জন্য, ছোট্ট একটা নিয়ম ভাঙতে পারবো না আমি?

ছেলেটিকে বুকে নিয়ে উঠে পড়লাম আমি। তারপর COকে বললাম-
স্যার, যদি অনুমতি দেন তো একে আমার অফিসে নিয়ে যাচ্ছি।

CO প্রথমে চিতার দিকে চেয়ে দেখলেন। দেখলেন, সব শেষ। সব ভস্মীভূত। হাবিলদার নেগি এখন অস্তিত্বহীন। পকেট থেকে রুমাল নিয়ে, চোখ মুছলেন উনি। তারপর মৃদুস্বরে আমাকে বললেন-
'যাও।'

চড়াই উৎরাই ১৭ (Trishna)
Wednesday, August 10, 2022
Topic(s) of this poem: bangla
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Close
Error Success