কিছু ব্যথা ফিরে ফিরে আসে।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো-
তারা তোমাকে ব্যথা দিতে আসে না
আসে, তোমাকে মুক্তি দিতে।
আমি তখন
মেডিক্যাল কলেজে পড়ি।
আমার মাস্টার মশায়ের এক বন্ধু
কথায় কথায় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন -
খোকা, তোমার বাবা কি করেন?
আমি বলেছিলাম-
'সাধারণ এক কেরাণী'।
উনি জিব কেটে বলেছিলেন-
'ছিঃ এমন ভাবে বলতে নেই।
বলো- অসাধারণ এক কেরাণী।
একজন কেরাণী হয়ে
যিনি তার ছেলেকে
মেডিক্যাল কলেজে পড়াতে পারেন;
তিনি সামান্য মানুষ হবেন কেন? '
আজ প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেলো-
ভদ্রলোকের সেই কথা আমি ভুলি নি।
আমার বাবা সামান্য হয়েও
এক অসামান্য মানুষ ছিলেন।
কলকাতা থেকে গ্রামে আসার সময়
বাবা আমাকে
হাওড়াতে বাসে তুলতে আসতো।
আমার পাশের সিটে বসা লোকটিকে,
বাবা বারবার অনুরোধ করতো-
'আমার খোকাকে একটু দেখবেন
ছেলে মানুষ। ভয় হয়। '
আমি লজ্জা পেতাম।
রাগে আমি খেঁকিয়ে উঠতাম-
'তুমি এবার যাও তো! '
অথচ মজার কথা হলো-
আমি যখন
আমার ছেলেকে স্কুল বাসে উঠাতে যেতাম,
আমিও বাসের কন্ডাক্টরকে
সেই একই অনুরোধ করতাম।
পিতৃ যন্ত্রণার চাকা ঠিক
এমনি করেই ঘুরে।
আমার বাবা দরিদ্র্য ছিলো বটে
তবুও অসামান্য মানুষ ছিলো।
কোনদিন তাকে আমি
সজ্ঞানে কোন অন্যায় করতে দেখি নি।
একদিন বাবা
অফিসের টাকা নিয়ে কাজে বেড়িয়েছিলো ।
বাসে এক পকেটমার
বাবার বুক পকেটে ব্লেড চালিয়ে দিয়েছিলো।
বাস থেকে নেমে
বাবা দেখলো পাঞ্জাবিতে তার রক্ত।
টাকা গায়েব। বুকে তার ক্ষত।
বাবা তড়িঘড়ি করে বাড়িতে এসে
মায়ের সোনার গহনা বেচে
অফিসকে টাকা ফেরত দিয়েছিলো।
আমি তার প্রতিবাদ করেছিলাম।
বাবা বলেছিলো-
'জীবনে অপরাধী সাজতে নেই, খোকা। '
আর কয়েকদিন পর
বাবার 'মৃত্যু দিবস'।
আমার মা আর ভাইয়েরা
প্রতিবছর তা নীরবে পালন করে।
আমি কিন্তু পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই।
এই সময়টা
মায়ের সাথে আমার কথা বলতে কষ্ট হয়
নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হয়।
মনে হয়-
আমি যদি একটু বেশি চেষ্টা করতাম
বাবা হয়তো আরও কয়েকবছর বাঁচতো।
বাবা কাছে থাকলে
ক্ষমা চাইতে পারতাম,
তা তো আর পারি না।
তাই
আকাশের দিকে চেয়ে কাঁদি
আর বলি-
'মাপ করো বাবা,
তোমার জন্য কিছুই করতে পারি নি।
পরজন্মে
আবার তোমার ছেলে হতে চাই।
আমার অকর্ম্মনতার
প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।'
জানো?
বাবারা কেবল
মরে যাওয়ার পরই কদর পাই।
দরিদ্র্য হলেও
বাবা বেঁচে থাকাকালীন
কোনদিন অসহায় বোধ করি নি আমি।
আজ আমি রাজা,
আমার সব আছে।
তবুও আমি অসহায়।
আমার মাথার উপর
শক্ত পোক্ত সেই ছাদ নেই।
© অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem