তোমরা কে জানতে চাও এই বাংলাকে?
- - - - - - - - - - - - - -
যারা গরীব-
তাদেরও হৃৎপিণ্ড আছে। সেই হৃৎপিণ্ডে ভালোবাসাও আছে।
তাদেরও স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্নে রামধনুও আছে।
কিন্তু গরীবকে আমরা কতটুকু মানুষের মর্যাদা দিই? বড়লোকে- খাবার ফেলে দেয়, বা রাস্তার কুকরকে ডেকে সেই খাবার খাওয়ায়। আর রাস্তার একটা ছোট্ট ছেলে, ছলছল চোখে- সে দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনের মধ্যে ইচ্ছে হয়- এখুনি দৌড়ে গিয়ে কেড়ে খায় সে কুকুরের মুখের খাওয়ার।
ছবিটা কিন্তু একটুও অতিরঞ্জিত নয়। হৃদয়ের জানালা খোলা রাখলে, এমন ঘটনা কলকাতাতে আমি আকছার দেখি। আমার গ্রামে এমনও মানুষ দেখি- যারা সকালে কেবল কাঁচা লঙ্কা দিয়ে পান্তা ভাত খায়। দুপুরে কেবল আলু সেদ্ধ দিয়ে ভাত খায়। রাতেও তারা আলু সেদ্ধ ভাত খায়। এ ছবি কোন পুরানো দিনের ছবি নয়। এ ছবি টাটকা বর্তমানের।
মেদিনীপুর, হুগলী, হাওড়া, বাঁকুড়া, বর্দ্ধমান জেলার অনেক বাচ্চা বাচ্চা ছেলে- মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যে গিয়ে সোনার দোকানে কাজ করছে। তাদের কারও কারও বয়স আট বা দশের বেশি নয়। একটা ১০ ফুট x১২ ফুট ঘরে, ১৫ জন একসাথে কাজ করে। কাজ শেষে সেই ছোট্ট জায়গায়, রাত দুটো বা তিনটের সময় তারা ঘুমিয়ে পড়ে। সেই ঘরে কোন সূর্যের আলো নেই, কোন ভেন্টিলেশন নেই। সারাদিন প্রদীপ আর বার্নার জ্বলার কারনে- সেই ঘর কার্বন ডাই অক্সাইড আর কার্বন মনোক্সাইড পূর্ণ। অল্প বয়সী ছেলেরা তাই রক্তাল্পতা, ফুসফুস আর হৃৎপিণ্ডের রোগে ভুগছে।
এ ছবি- কারও মুখ থেকে শোনা নয়। এ ছবি আমি নিজে চোখে দেখেছি। বোম্বে, সুরাট, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি শহরে গিয়ে- আমি নিজে এই সব ছেলেদের সাথে কথা বলেছি। এদের কারও কারও চিকিৎসাও করেছি আমি। এদেরকে জিজ্ঞেস করলে এরা বলে-
"কি করবো দাদা, বাবা কিছু করে না। সে কেবল মদ খেয়ে মাকে পেটায়। আমাদের জমিজমাও কিছু নেই।" এসব কথা বলেই- "ন" বা "দশ" বছরের ছেলেগুলো কান্নায় ভেঙে পড়ে।
সংবাদপত্র এদের খবর রাখে না। বিধায়ক এদের খবর রাখে না। মন্ত্রীও এদের খবর রাখে না। "গরীবের সরকার বামফ্রন্ট" ৩৪ বছর শাসন করে গেলো, কিন্তু আমার গ্রামের চেহারা এখনো বদলায় নি। "মমতাময়ী মা" মমতা ব্যানার্জী ৭ বছর ধরে শাসন করছে- অথচ আমার গ্রামের অবস্থা একটুও বদলায় নি। তাহলে কি বদলেছে?
আমি তখন খুব ছোট্ট। বিকেলে খালি গায়ে মাঠে ঘুড়ি উড়াচ্ছি। হটাৎ দেখি- ধূলো উড়িয়ে "পাইলট কার" সহ একটা গাড়ি হুশ করে চলে গেলো। পরে জেনেছিলাম- উনি ছিলেন তখনকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী অম্বরীষ মুখার্জী। উনি আমাদের পাশের গ্রামে একটা হাসপাতাল উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। হাসতাপালের কয়েকটা দেওয়াল উঠেছিলো তখন। আজ প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেলো- সেই দেওয়ালগুলো ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে রয়েছে। বিল্ডিংও সম্পূর্ণ হয় নি, হাসপাতালও কোনদিন হয় নি।
বামফ্রন্ট সরকার জনগণকে প্রথম টুপি পরানো শুরু করেছিলো। ভোটের আগে অমুক উদ্বোধন, তমুক উদ্বোধন ইত্যাদি। আজকাল মমতা ব্যানার্জী তার প্রতি মিটংয়ে নাকি ৫০০ থেকে ১০০০ প্রকল্প ঘোষণা করেন। এতো যদি প্রকল্প হচ্ছে- সেগুলো যাচ্ছে কোথায়? আমারগ্রামটা কি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পড়ে না?
রাজনীতিকরা যা প্রকল্প ঘোষণা করে, তার দশ হাজার ভাগের এক ভাগও যদি বাস্তবে রূপায়িত হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গ তিনমাসে সুইজারল্যাণ্ড হয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গ তো সুইজারল্যান্ড হয় নি। তাহলে এই ঘোষিত প্রকল্পগুলো কি ডাহা মিথ্যাচার নয়? একজন মানুষ কিভাবে এতো হাজার হাজার মিথ্যে, লক্ষ লক্ষ মানুষ আর মিডিয়ার সামনে বলতে পারে? কেন মানুষ এই মিথ্যার প্রতিবাদ করে না? কেন মিডিয়া এই মিথ্যার প্রতিবাদ করে না? কেন শিক্ষিত ভদ্রলোক এই মিথ্যার প্রতিবাদ করে না?
তোমাদেরকে আগেই বলেছি- কিছুদিন আগে আমার প্রাইমারী স্কুলের বন্ধু, বন্যার জলে ভেসে গিয়ে মরে গেলো। কুড়ি লক্ষ মানুষ দেড় মাস অনাহার আর রোগে যন্ত্রণা পেলো, অথচ বাংলার কোন কাগজ সে ব্যাপারে কিছুই লিখলো না। এতো মৃত্যু, এতো অনাহার, এতো দারিদ্র্য- তার খবর কেন বাংলার মানুষ জানে না?
এসব কি গ্রামের অশিক্ষিত দুর্বল দরিদ্র্য মানুষকে অপমান নয়। তা কি মনুষত্বের অপমান নয়। অথচ এরাই নাকি "মানবতার" কারনে মিডিয়া আর বুদ্ধিজীবী সহ কলকাতার রাস্তায় মোমবাতি মিছিল করে!
বাংলার মধ্যে, এ কোন বাংলা? কলকতার লোক কেন এই বাংলাকে চেনে না? কেন নেতা মন্ত্রী এই বাংলাকে চেনে না? বাংলার মিডিয়া কেন এই বাংলাকে চেনে না? কোন নেতা মন্ত্রী যদি অরুণ মাজীকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়- আমি তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে আমার গ্রাম তার পাশাপাশি দশটা গ্রাম ঘুড়িয়ে দেখাবো। কেউ কি আছে- যে এই বাংলাকে জানতে চায়?
© অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem