সাহস মানে ভয় শূন্যতা নয়। সাহস হলো ভয়কে জয় করার দৃঢ় সংকল্প। ভয় সকলেরই হয়। তোমারও হয়। আমারও হয়। মৃত্যুকেও ভয় হয় আমাদের।
ব্যাপারটা গভীর ভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি আমি। গভীর করে খুঁড়তে গিয়ে দেখেছি, নিজের মৃত্যুকে খুব বেশি ভয় পায় না আমি। কিন্তু অন্যের মৃত্যু, আমার মধ্যে কেমন এক শূন্যতা তৈরী করে। আমাকে বড় বিমর্ষ করে।
১৯৯৯ সাল। আমি তখন কার্গিল যুদ্ধে ব্যস্ত। মৃত্যু, কত বার যে আমাকে ছুঁয়ে গেছে, তা আমি গুনতে পারি নি। একবার, ২ কিলোমিটার উঁচু এক পাহাড়ে, আমার গাড়ি, তিন পাক শূন্যে পাক খেয়ে, উল্টে গেলো। সেই রাস্তার এক পাশে খাড়া পাহাড়, অন্য পাশে অন্তত এক কিলোমিটার গভীর খাদ। আমার গাড়ির সবাই আহত। কেবল আমিই ১০০ ভাগ অক্ষত।
একবার এক জঙ্গলে ট্রেনিং করছি আমরা। একটা "আর্টিলারি শেল" হটাৎ দুম করে আমাদের মধ্যে পড়লো। ১৪ জন আহত। তিন জন গভীর ভাবে আহত। সেই তিন জনকে হেলিকপ্টারে হাসপাতালে পাঠালাম আমি। তখনও, আমিই কেবল ১০০ ভাগ অক্ষত।
একবার আমরা কয়েকজন জঙ্গল দিয়ে হাঁটছি। হটাৎ শোঁ শোঁ করে কতকগুলো জিনিস, আমার কানের কাছ দিয়ে উড়ে গেলো। ভাবছি ব্যাপারটা কি! তারপর দেখলাম আরও একটা "ট্রেসার বুলেট", আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো।
একবার ফায়ারিং চলাকালীন এক হাবিলদারকে চিকিৎসা করতে যাচ্ছি আমি। হটাৎ একটা "মর্টার" আমার গাড়ির বাঁ দিকে পড়লো। আমার গাড়ি এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেলো। কিন্তু আমাদের কেউই সেদিন আহত হয় নি।
এরকম কয়েকশো ঘটনার সাক্ষী আমি। কাশ্মীরে সাড়ে তিন বছর কাটানোর পর, আমি যখন "কলকাতা কমান্ড হাসপাতালে" পোস্টিং আসছিলাম- রাস্তায় আসতে আসতে, মৃত্যুকে সেদিন প্রণাম করেছিলাম আমি। মৃত্যু করুণাবশতঃ আমাকে অপাঙতেয় রেখেছিলো।
বাঁচতে আমি ততটুকু চাই, যতদিন আমার দেহ আর মন সতেজ থাকবে। শারীরিক বা মানসিক ভাবে আমি যেদিন অক্ষম হয়ে পড়বো, আমি সেদিন আর বাঁচতে চাইবো না। কক্ষনো না। আমি সৈনিক। ভিক্ষা আর করুণার জীবনকে ঘৃণা করি আমি।
আমার আগামী মৃত্যু আমাকে কখনো ভাবায় না। কিন্তু অন্যের মৃত্যু আমার হৃদয়ের মধ্যে, খাঁ খাঁ এক শূণ্যতা তৈরী করে।
আজ ডিনার করতে করতে, বাবার কথা মনে পড়লো আবার। আমি যখন মেডিক্যাল কলেজে পড়ি, মাঝে মাঝে আমি, বাবার কাছে আসতাম। বাবা আমাকে, নিজে রান্না করে খাওয়াতো। হার্ট এট্যাকের পর, বাবা তখন ভীষণ দুর্বল। তবুও আমার জন্য রান্নাতে, তার উৎসাহের কোন সীমা ছিলো না। তার ভালোবাসার গভীরতার কথা ভাবলে, নিজেকে বড় ক্ষুদ্র, হীন আর অকর্মণ্য মনে হয়। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। বুকটা গভীর এক শূণ্যতায় খাঁ খাঁ করে। চোখে জল গড়িয়ে আসে।
এরপর মেজোকাকা, সেজোকাকা, ছোটকাকা, বড় জামাইবাবু- সবাই চলে গেলো। এদের অনেকের ভালোবাসা আমার রক্তে। এদের অনেকের ঘাম আর রক্ত দিয়ে আমার জীবন তৈরী। এদের অনুপস্থিতি, আমার একটা একটা অঙ্গহীনতা।
মাঝে মাঝে ভাবি- এদের বিনা, আমি কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি? আমি অন্তত তাই ভাবি। যাদের দিয়ে আমি তৈরী, তাদের বিনা আমি দুর্বল তো হবোই।
আমার অনেক কাছের বন্ধুও চলে গেছে। মরণ সম্পর্কে যখন ভাবি, তখন এরা সবাই আমার চেতনায় আবির্ভাব হয়। এরা সবাই হেসে হেসে আসে। কিন্তু আমিই কেবল কাঁদি। কেন কাঁদি? ভালোবাসি বলে?
নাহঃ। আমি কাঁদি, ভালোবাসা পেয়েছি বলে। এরা সবাই কত সক্ষম। এরা সবাই কত ভালোবাসে। আমিই কেবল সেই ভালোবাসাকে যথার্থ সন্মান দেখাতে পারি নি। এদের আলো, আমার মধ্যেকার অন্ধকারকে চিনিয়ে দেয়।
আমি চেষ্টা করছি, প্রতিদিন একটু একটু করে ভালো মানুষ হতে। কিন্তু কতটা পারি আমি? বেশির ভাগ সময় ডাহা ফেল করি আমি। একশোতে শূণ্য পাই আমি।
দুঃখ তাই বাড়ছে আমার- এখনো আমি ভালো একটা মানুষ হতে পারলাম না!
© অরুণ মাজী
Painting: Aaron Wasterberg
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem