(ঈশ্বর কি? কেন? মানুষ তার সাধনা করবে কেন? এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি এই প্রবন্ধে।)
'আমি' ছাড়া, অন্য কারও অস্তিত্ব 'অস্বীকার' করার মধ্যে কোন বাহাদুরি নেই। স্বার্থপর নেমকহারাম মানুষ, তা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তেই করে। যার গর্ভে আমরা জন্মেছি, সেই গর্ভধারিণীর অস্তিত্ব অস্বীকার করে, তাকে আমরা- বৃদ্ধাশ্রমে অনাহারে ফেলে রাখি। যে নদী আমাদেরকে- শস্য দেয়, পানীয় দেয়; তার বুকে বিষ মিশিয়ে, তাকে আমরা বিষাক্ত করে দিই। কাজেই- এই নদী, পাহাড়, আকাশ, সূর্য ইত্যাদির যে স্রষ্টা; তাকেও যে আমরা অস্বীকার করবো, তাতে বড় কোন আশ্চর্য্য নেই।
এখন প্রশ্ন হলো এই নদী, পাহাড়, আকাশ, সূর্যের স্রষ্টা কে? সব কিছুরই একটা মৌলিক উৎস থাকে। তবে মানুষের উৎস কে? পিপীলিকার উৎস কে? সূর্যের উৎস কে? গ্যালাক্সির উৎস কে? বিজ্ঞান বলে- এ সবেরই উৎস হলো, ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে ঘটে যাওয়া 'বিগ ব্যাং'। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই 'বিগ ব্যাং'-এর উৎস কি? এর উত্তর বিজ্ঞান এখনো জানে না।
অথচ এই বিজ্ঞানেরই মূল প্রতিপাদ্য হলো- সব কিছুরই একটা কারন আছে। একে বিজ্ঞান বলে- Cause and Effect Relationship. এখন বিজ্ঞান যদি ধরে নেয়- 'বিগ ব্যাং'-এর কোন উৎস নেই, 'বিগ ব্যাং' নিজেই নিজের উৎস; তাহলে বিজ্ঞান- বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে।
এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের স্রষ্টা কে? এই বিতর্ক হয়তো আরও কোটি কোটি বছর ধরে চলবে। কে ঠিক, বা কে ভুল; তা বলা খুব মুশকিল। কারন মানুষ এখনো বড় নির্বোধ। মানুষ এখনো তার- ক্ষুদ্র শরীর আর মনকেই ভালো করে বোঝে না। তাহলে মানুষ কি করে এই 'অসীম আয়তন বিশিষ্ট বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের' শরীর আর মন-কে বুঝবে?
তা বলে মানুষ কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? অবশ্যই না। মানুষ তার জ্ঞানের পরিধি ক্রমশ বাড়াতেই থাকবে। মানুষের এই সাহসিকতা আর নিষ্ঠার তারিফ, আমাদেরকে করতেই হবে। এই জন্যই পৃথিবীর সমস্ত বিজ্ঞানী আমাদের কাছে পরম পূজ্য।
জ্ঞানের অন্বেষণ ভালো, কিন্তু জ্ঞানের অহঙ্কার ভালো নয়। এই অসীম আয়তন বিশিষ্ট বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের তুলনায়- মানুষের আকার, বুদ্ধি, শক্তি অতীব ক্ষুদ্র। মানুষকে তা স্বীকার করতেই হবে। মানুষ যদি সেই বিনয় না দেখায়- মানুষ তার নিজের ক্ষতি করবে।
অসীম শক্তির কোন জিনিসকে, কেবল অসীম শক্তিরই কেউ জানতে পারে। ঠিক যেমন- একজন অঙ্কবিদই ভালো করে বলতে পারবে, আর এক অঙ্কবিদ- ঠিক কতটা বড়। একজন মূর্খ চাষা তো বলতে পারবে না, রামানুজন ঠিক কতটা বড় অঙ্কবিদ ছিলেন! বিশ্ব ব্রহ্মান্ড যেহেতু- আয়তন আর শক্তিতে অসীম, তাই তাকে জানতে হলে অসীম শক্তির কাউকে দরকার।
এখন প্রশ্ন হলো- মানুষ কি অসীম শক্তির জীব? অবশ্যই না। মানুষ যেহেতু কোনদিনই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডকে জানতে পারবে না, সেহেতু মানুষ তার উৎসকেও, কখনো জানতে পারবে না। খুব বেশী হলে- মানুষ তার আংশিক রূপ জানতে পারবে। সেই আংশিক রূপ কখনোই পুরোপুরি সত্য হবে না।
কাজেই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের উৎস যে কি, মানুষ তা জানে না। অথচ, সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখো- দেখবে, সেখানে এক অসম্ভব সুন্দর তাল, ছন্দ আর রূপ। দিনের পরে রাত, রাতের পরে দিন। জন্মের পরে মৃত্যু, মৃত্যুর পরে জন্ম। সুখের পর দুঃখ, দুঃখের পরে সুখ। পৃথিবীটা সূর্যের চারিদিকে বনবন করে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ঘুরছে। আমাদের হৃৎপিন্ডটা ধকপক করে, বছর বছর বাজছে। এই তাল, এই সুর, এই ছন্দ, এই অপরূপ রূপ কি এমনি এমনি হয়ে গেলো? 'মোনালিসার স্বর্গীয় পেন্টিং-টা এমনি এমনি হয়ে গেলো' বললে যেমন হাস্যকর শোনাবে; 'বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের অসীম রূপ এমনি এমনি হয়ে গেলো' বললে তার থেকেও অনেক বেশী হাস্যকর শোনাবে।
মোনালিসা গড়তে যেমন এক সর্ব্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীর দরকার হয়েছিলো, বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের এই অপরূপ সৌন্দর্য্য গড়তেও ঠিক তেমনি এক অসীম প্রতিভার শিল্পীর দরকার হয়েছিলো। সৃষ্টিতে, শুধু কি শিল্পই আছে? গণিত নেই? ফিজিক্স নেই? বায়োলজি নেই? কেমিস্ট্রি নেই? সৃষ্টিতে, এসবই অসীম পরিমানে আছে। তবে কে সেই- বহুমুখী, অসীম প্রতিভা আর শক্তির মালিক?
অনেক মানুষ তাকে ঈশ্বর বলে। তারা কি ভুল বলে? দুর্ভাগ্য- মানুষ অহঙ্কারী আর স্বার্থপর। সে তার মাতাকে অস্বীকার করে। সে মাতৃসম- তার দেশকে অস্বীকার করে। সে তার ধারক আর পালক- মাতৃসম নদীকে অস্বীকার করে। মানুষ তার নিজেকে ছাড়া, অন্য সকলকেই অস্বীকার করতে চায়। কাজেই মানুষ যে এই সৃষ্টির স্রষ্টাকেও অস্বীকার করবে, তাতে কোন আশ্চর্য্য নেই।
এখন প্রশ্ন হলো- স্রষ্টাকে স্বীকার করার মধ্যে, মানুষের কি কোন লাভ আছে?
ধরো- তুমি জানো, তোমার মা নেই। নিজেকে তখন কেমন মনে হয়? মাতৃহারা, হতভাগা, অনাথ এক শিশু। বুকটা কেমন ফঙ ফঙ করে, হৃদয়টা কেমন- থেকে থেকে, ডুকরে ডুকরে উঠে। হৃদয়ে মায়ের উপস্থিতি হলো- এক বিশাল সাহস আর পূর্ণতা। কারন তুমি জানো- তোমার শরীর খারাপ হলে, মা তোমার কপালে হাত বুলিয়ে দেবে। তোমার মা হয়তো- তোমাকে রোগ মুক্ত করতে পারবে না, কিন্তু সে- তোমার আর্ত পীড়িত মনে, একটু শান্তি দেবে।
হৃদয়ে, ঈশ্বরের উপস্থিতিও ঠিক তাই। ঈশ্বর তোমার এক সাহস, আর পূর্ণতা। তাকে তুমি দেখতে পাও, আর না পাও; তুমি যদি তার অস্তিত্ব দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করো- তাহলে তুমি বুকে বল পাবে, মনে শান্তি পাবে। যখন তুমি আর্ত আর নিপীড়িত বোধ করবে, তখন তুমি তার কথা স্মরণ করে অনেক নিরাময় পাবে। ঈশ্বর স্মরণে, হয়তো তোমার দুঃখ ঘুচে যাবে না। কিন্তু তোমার যন্ত্রণার অনেক লাঘব হবে। সেই পাওয়া কি কম পাওয়া? মানুষের জীবন তো, প্রতি মুহূর্তেই যন্ত্রণাময়! সেই যন্ত্রণাতে, তুমি যদি কারও নিঃশর্ত সাহচর্য পাও, তাতে তো তোমার লাভই বেশি।
সুখের কথা হলো, ঈশ্বরের এই সাহচর্য পেতে হলে, তোমাকে- পন্ডিত হওয়ার দরকার নেই, গাদাগাদা ধর্ম গ্রন্থ পড়ার দরকার নেই, কোন নির্দিষ্ট ধর্মের ধর্মস্থানে যাওয়ার বাধ্যকতাও নেই। আবার তুমি যদি তা করতে চাও, তাতেও কোন আপত্তি নেই। তোমার ঈশ্বর সাধনা- তুমি যেভাবে চাইবে, তুমি সেভাবেই করতে পারো।
ঈশ্বরের উপলব্ধি খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ তোমার হৃদয়ের কথা। আপন মায়ের প্রতি, তোমার ভালোবাসা যেমন তোমার একান্ত হৃদয়ের ব্যাপার, ঈশ্বরের প্রতি তোমার ভালোবাসাও ঠিক তাই। তুমি যেমন তোমার মা-কে বুকে বেঁধে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে- তোমার মাতৃপ্রেম দেখাও না; ঠিক তেমনি ঈশ্বরের ছবি বুকে নিয়ে, রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শনী করে, তোমার ঈশ্বর প্রেম দেখানোর কোন দরকার নেই। তুমি যেমন রাস্তার লোকের সঙ্গে- তোমার মা বড়, আর অন্যের মা ছোট বলে ঝগড়া করো না; ঠিক তেমনি তোমার ঈশ্বর বড়, আর অন্যের ঈশ্বর ছোট বলে, তোমার কারও সাথে ঝগড়া করারও দরকার নেই।
ঈশ্বর এক অনুভব। তাকে তুমি একান্তে, এই মুহূর্তেই, তোমার নিজের মতো করে অনুভব করতে পারো। তোমরা সবাই ভালো থেকো।
© অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem
Excellent. Khub valo