পাহাড়ি মেয়ে খন্ড ৫৬ (Himel 56) Poem by Arun Maji

পাহাড়ি মেয়ে খন্ড ৫৬ (Himel 56)

বাড়ি ভর্তি লোকজন। সঙ্গে সানাইয়ের সুর। ট্রাম্পেটের পোঁ পোঁ। ব্যান্ড পার্টির দুম দুম।

তুমুল হৈ চৈ। চীৎকার। চেঁচামেচি। ছুটাছুটি। দাপাদাপি। হাসাহাসি। তর্কাতর্কি। ঘটনা। এমনকি দুর্ঘটনা। বড় কিছু নয়, ছোটখাটো। কেউ হোঁচট খাচ্ছে। কেউ গড়িয়ে পড়ছে।

এরই নাম বিয়ে। হ্যাঁ বিয়ে। দর্পণ চ্যাটার্জীর সাথে অমল বোসের বিয়ে। বহু প্রতীক্ষিত বিয়ে।

সত্যি কথা বলতে কি, খেই হারিয়ে ফেলছি আমি। বারবার। বাড়িতে যারা আসছেন, তারা সবাই আমার আত্মীয় বা বন্ধু। তারা সবাই আমার কাছের। আমার জন্যই তারা আজ এসেছেন। তাই তাদেরকে সমুচিত শ্রদ্ধা জানানো, তাদের সঙ্গে দুটো কথা বলা, তাদের আবগেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, হাসি হাসি মুখে তাদের সঙ্গে দুটো একটা সেল্ফি তুলা- এসবই আমার একনিষ্ঠ কর্তব্য। লিখিত নয়, অলিখিত। অলিখিত হলেও, তা কিন্তু ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ।

আর বিপদটা ঠিক এখানেই। এতো লোকের আবেগকে, এক সাথে সন্মান জানানো বেশ কঠিন কাজ। কেন কঠিন? যে কেউ ভাবতে পারে, তাকে আমি যথাযোগ্য নজর দিই নি। তবুও, এই অসাধ্যকে সাধন করার জন্য সারাদিন ধরে লড়াই করলাম আমি। ফল? এখন সবে সন্ধ্যে। আর এখনই আমি রীতিমত পর্যুদস্ত।

অথচ আজ কিন্তু আমার বিয়ে। আর আমিই কিনা ক্লান্ত অবসন্ন।

গোদের উপর বিষফোঁড়া এই যে, বিয়ের লগ্ন, রাত্রি দুটোর সময়। হ্যাঁ, রাত্রি দুটো। বাঙলা সংস্কৃতি অনুযায়ী, লগ্ন না মানলে বিয়ে শুভ হয় না। তাই লগ্নের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কে জানে, বিয়ে শেষ হতে হতে হয়তো সকাল হয়ে যাবে।

অথচ এই ক্লান্তি নিয়েও, আমাকে চোখ মেলে জেগে থাকতে হবে। ঈশ্বরকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করতে হবে। শপথ নিয়ে বলতে হবে, 'যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম'।

কথাটা হলো- বিয়ে আমরা সবাই করি, কিন্তু এই বিয়ে ব্যাপারটা কি? আমরা ক জন তা, ভালো করে বুঝি? আমরা বিয়ে করি কেন? বিয়ে না করলে মহাভারত ঠিক কতটা অশুদ্ধ হতো?  বিয়ে না করেও, পুরুষ আর নারী কি একসাথে থাকতে পারে?

আজকাল তো অনেকেই তা করে! তাতে অশুদ্ধিটা কি?

সমাজবদ্ধ জীবনে, অনেক কিছু বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করতে নেই। তা যদি তুমি করতে চাও, তো জীবনে  তোমার যন্ত্রণা বাড়বে।

সব কিছু তুমি যদি বিজ্ঞানের পথে উত্তর খুঁজতে চাও, তো তুমি একাকী হয়ে যাবে। একঘরে হয়ে যাবে। এমনকি তোমার আত্মীয় বন্ধুবান্ধবও তোমাকে পরিত্যাগ করবে। সমাজ চাই, মস্তিস্কহীন কৃমির মত তুমি পঙ্গু থাকো। তুমি পঙ্গু না থাকলে, সমাজ নামের বুড়ো ভাম বেঁচে থাকতে পারে না।

সমাজ চায়- উইপোকা খাওয়া শাস্ত্রের মধ্যে আলো খুঁজো তুমি। তোমার উত্তরণ খুঁজো তুমি। তোমার মুক্তি খুঁজো তুমি। উইপোকা খাওয়া তো কি? উইপোকা খাওয়া শাস্ত্র বলে, তা অপবিত্র হয়ে যাবে? !

তো শাস্ত্র মতে বিয়ে কি? "বিবাহ" শব্দটি  (বি) পূর্বক (বহ্) ধাতু, ও (ঘঞ্) প্রত্যয়যোগে তৈরী। (বহ্) ধাতুর অর্থ বহন করা এবং (বি) " উপসর্গের অর্থ বিশেষরুপে।

অতএব বিবাহ শব্দের অর্থ হলো- বিশেষ রুপে বহন করা। অর্থাৎ বিবাহের মাধ্যমে, একজন পুরুষ, তার স্ত্রীর ভরণ-পোষণ এবং মানসম্ভ্রম রক্ষার সার্ব্বিক দায়িত্ব নেয়। বেদে বলা হয়েছে-
উদীর্স্বাতো বিশ্বাবাসো নমসেলামহে ত্বা।
অন্যামিচ্ছ প্রফর্ব্যং সং জায়াং পত্যা সৃজ।।

অর্থাৎ তুমি যাও, অবিবাহিতা নারীকে তোমার অর্ধাঙ্গিণী কর। এবং তাকে সমান অধিকার প্রদান কর। উরিবাব্বা! কি সাংঘাতিক গুরুতর ব্যাপার! তাই না?

হিন্দু শাস্ত্র মনুসংহিতায়, আট রকম বিয়ের উল্লেখ রয়েছে। সেগুলো হলো-
(১) ব্রাহ্ম
(২) আর্য
(৩) প্রাজাপত্য
(৪) আসুর
(৫) গান্ধর্ব
(৬) রাক্ষস
(৭) দৈব
(৮) পৈশাচ

আমাদের দেশে ব্রাহ্ম বিবাহই স্বীকৃত এবং পালনীয়। ব্রাহ্ম বিবাহ হলো - কন্যার পিতা, তার কন্যাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে, অলংকার দিয়ে সাজিয়ে, কোন বিদ্বান ও সদাচারী পুরুষের হাতে তুলে দেবেন।

লক্ষণীয়, শাস্ত্র মতে, বিবাহকামী রুষকে বিদ্বান ও সদাচারী হতে হবে! অর্থাৎ তুমি যদি শাস্ত্রের কথা মানো, তাহলে- চোর ডাকাত খুনী বা মূর্খদের গলায় কোন নারী বরমাল্য পরাবে না। অর্থাৎ শাস্ত্রমতে  চোর ডাকাত খুনী বা মূর্খদের বিয়ে হওয়া উচিত নয়।

বোঝো ঠ্যালা! তো চোর ডাকাত খুনী বা মূর্খরা কি তাহলে বিয়ে করবে না?

ওহে মুখপোড়া শাস্ত্র, চোর ডাকাত মূর্খ বলে কি, মানুষ নয় তারা? তাদেরও কি ছাদনা তলায় টোপর পরে, 'যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম' মন্ত্র উচ্চারণ করতে সাধ জাগে না? দুঃখের বিষয় হলো, মুখপোড়া শাস্ত্র এই প্রশ্নের ব্যাপারে নীরব।

অতীত ভারতে, গান্ধর্ব বিবাহও ঘটতো। গান্ধর্ব্য বিয়েতে, নারী আর পুরুষ পরস্পরের কাছে শপথ করতো, তারপর তারা পরস্পরেরগলায় মালা পরিয়ে দিত।  মহারাজা দুষ্মন্ত আর ঋষিকন্যা শকুন্তলা, গান্ধর্ব্য মতে বিয়ে করেছিলেন।

আমার দুঃখ আমি অমল বোস। মহারাজা দুস্মন্ত নই। দর্পণকে, বারো বছর আগে, গান্ধর্ব্য মতে বিয়ে করেছি আমি। কিন্তু আমার সেই বিয়েকে কেউ বিয়ে বলে মানে না। সেদিন মদের নেশায় আচ্ছন্ন ছিলাম ঠিকই। কিন্তু তাই বলে কি, সেই বিয়ে নগণ্য হয়ে গেলো?

আমি চাই, আধুনিক ভারতেও, গান্ধর্ব্য বিয়ে চালু হোক। তাহলে অন্তত রাত জেগে, অর্দ্ধাহারে, কোন পুরুষ বা নারীকে মন্ত্রপাঠ করতে হবে না। আপনারাই বলুন, পেটের মধ্যে আগুন জ্বললে, ঈশ্বর স্তুতি গাওয়া যায়? ঘুমে, চোখ ঢুলু ঢুলু করলে ঈশ্বর স্তুতিতে ভক্তি আসে?  

হিন্দু বিয়েতে শাস্ত্রীয় আচার কি? শুভলগ্নে, নারায়ণ অগ্নি শিব দূর্গা গুরু ইত্যাদি দেবতাকে, ভক্তিভরে আহ্বান করতে হবে। পুরোহিত এবং আত্মীয় স্বজনদেরকে সাক্ষী রাখতে হবে। তারপর 'মঙ্গল' মন্ত্র উচ্চারণ হেতু, উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে তোমাকে বিয়ে করতে হবে। তারপর বিয়ে শেষ হতে হবে, যজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

অগ্নি দেবতার কাছে শপথ না করলে, হিন্দু শাস্ত্র মতে কোন কিছুই হয় না। আগুনের দিব্যি দিয়ে বললে, মিথ্যেও নাকি সত্যি হয়ে যায়!

যাক গে, কি যেন বলছিলাম? ও হ্যাঁ, অগ্নি দেবতার কাছে কি শপথ করতে হয়?
"যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম ।
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব ।।
তোমার এই হৃদয় আমার হোক। আমার এই হৃদয় তোমার হোক।

আমি অমল বোস, বিজ্ঞানের ছাত্র। কোন কিছু গবেষণা না করে, তা গ্রহণ করা আমার স্বভাব নয়। গতরাতেও তাই রাত জেগেছি আমি। বিয়ে করার আগে, হিন্দু শাস্ত্রের পোস্ট মর্টেম করেছি আমি।

তবে লুকিয়ে লুকিয়ে, আপনাদের কানে কানে আরও একটা কথা বলছি আমি। তা হলো,  আমার গবেষণার উদ্দেশ্য, কেবল গবেষণা নয়।  বিয়ে সম্পর্কে আমি ঠিক কতটা সিরিয়াস, তা আমার হবু বৌকে জানাতে চাই আমি।

কম্পিউটারের প্রোগ্রাম যেমন লিখতে পারি আমি, ঠিক তেমনি ঊপনিষদের দু-কলি শ্লোক গাইতেও পারি আমি।  এমন বীর না হলে, বাঙালী মেয়ে আমাকে গ্রহণ করবে কেন? আমাকে ভরসা করবে কেন? তাও, দর্পণের মত এমন বিদুষী নারী?

অতএব, আমার গবেষণার উপরোক্ত ফল, দর্পণকে Whatsaap মারফত লিখে পাঠিয়েছি আমি। আর দর্পণ তার কি উত্তর করেছে?
'তুমি এখনো জেগে? তুমি না, বড় পাগল।'

পৃথিবীতে এমন কোন বাঙালী পুরুষকে আমি জানি না, যে তার অর্দ্ধাঙ্গিনীর আদুরে গলায় 'পাগল' ডাক শুনতে চায় না! অর্থাৎ, আমার রাত জাগা আর গবেষণা দুইই সার্থক। আমি ধন্য। ওহে ঈশ্বর মহা ধন্য আমি। দর্পণ আমাকে পাগল বলে গালি করেছে! ভাবা যায়!

ওহে দর্পণ, জেগে আছো তুমি? আর একবার পাগল বলে ডাকবে আমায়?

© অরুণ মাজী

পাহাড়ি মেয়ে খন্ড ৫৬ (Himel 56)
Monday, January 3, 2022
Topic(s) of this poem: bangla
COMMENTS OF THE POEM
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Close
Error Success