উন্মাদ অরুণ মাজীর উলঙ্গ দর্শন (Philosophy Of A Naked Poet) Poem by Arun Maji

উন্মাদ অরুণ মাজীর উলঙ্গ দর্শন (Philosophy Of A Naked Poet)

Rating: 5.0

ফড়িঙের নাকে ফুঁ দিয়ে, আমি যখন ভোঁ ভোঁ করে ভেঁপু বাঁশি বাজাচ্ছি, পেন্তীর মা জিজ্ঞেস করলো আমায়-
"উন্মাদ, মেলা দেখতে যাবি"?
আমি বললাম-
"না গো পেন্তীর মা, আমার অত পয়সা নেই।"
পেন্তীর মা বললো,
"তাতে কি? তুই যা চাইবি, তোকে আমি তাই কিনে দেবো।"

মেলাতে ঢুকতে না ঢুকতেই, সটান আমি ভেঁপু বাঁশির দোকানে। নাচতে নাচতে আমি পেন্তীর মাকে বললাম-
"পেন্তীর মা, আমি ওই ভেঁপু বাঁশিটা নেবো।"

ভেঁপু বাঁশি আমার জীবনের ধ্যান জ্ঞান তপস্যা। পকেটে কেবল পয়সা নেই বলে, আমি এখনো একটাও ভেঁপু বাঁশি কিনতে পারি নি। তাই- কখনো ফড়িঙের নাকে ফুঁ দিয়ে, কখনো টিকটিকির কানে ফুঁ দিয়ে, ভোঁ ভোঁ ভেঁপু বাজাই আমি। যেদিন ফড়িং টিকটিকি ধর্মঘট করে, সেদিন বিন্দী বুড়ীর, উনুনের চোঙাতে ফুঁ দিয়ে ভেঁপু বাজাই আমি।

আহাঃ সেই অমৃত সমান ভেঁপু বাঁশি, আজ- আমার হাতে। আনন্দ আমার ধরে না গো, আনন্দ আমার ধরে না! মেলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, বা গরু-কুকুর-ছাড়পোকা- যাকেই আমি দেখি, তারই কানের কাছে গিয়ে, ভোঁ করে ভেঁপু বাজিয়ে দিই আমি।

অনেকক্ষন এইভাবে চলার পর, পেন্তীর মা আমায় বললো-
হ্যাঁরে উন্মাদ, সারারাত যদি ভেঁপু নিয়ে মত্ত থাকবি, তো মেলা দেখবি কখন? ঘুগনি খাবি কখন? ডিমের চপ খাবি কখন? নাগরদোলায় দুলবি কখন?

সত্যিই তো! এসব তো আমি ভেবে দেখি নি। সাত মাইল হেঁটে, এতো কষ্ট করে যে মেলা দেখতে এসেছি, তা কি শুধু ভেঁপু বাজানোর জন্য?

চোখ খুললেই স্বর্গ। অথচ দেখে কে? সকলের নজর তো কেবল নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের প্রতি। উন্মাদ অরুণ মাজী, কেবল ভেঁপু নিয়ে মত্ত। জগাই আর কালু, কেবল গাঁজা নিয়ে মত্ত। নগেন মাস্টার, কেবল সুদের কারবার নিয়ে মত্ত। মণি মুখুজ্যে, কেবল রাজনীতির টুপি খেলাতে মত্ত।

ভোরের সূর্য- পৃথিবীর যে কোন "আলোর বাহার"-কে হাসতে হাসতে হারিয়ে দেবে। গোধূলির সোনালী রূপ- পৃথিবীর যে কোন অপরূপকে নাচতে নাচতে হারিয়ে দেবে। কিন্তু দেখে কে?

মানুষ ধার দেনা করে, ভিন্ন কোন গ্রহে আলোর সৌন্দর্য্য দেখতে যাবে, তবুও ভোরের আকাশ সে দেখবে না। গোধূলির দিগন্ত সে দেখবে না। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে মানুষ গোয়া ভ্রমণে যাবে, কিন্তু তার প্রতিবেশীর তালপুকুরে সুন্দর যে বাগানটা আছে, তা মানুষ দেখবে না।

সব শালা অরুণ মাজীর মতো বদ্ধ উন্মাদ। অরুণ মাজী পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্য্যন্ত, চোঁ চোঁ করে ঘুড়ে বেরিয়েছে। কিন্তু মালবিকার ঠাম্মার "মিঠে পানের সবুজ বাগান" এখনো সে দেখে নি। হারামজাদা মিঠে পান খাওয়ার জন্য, মালবিকার ঠাম্মার পা পর্য্যন্ত টিপে দিয়েছে, কিন্তু"মিঠে পানের সবুজ বাগান" এখনো সে দেখে নি।

আজ সকলেই আপন আপন ভেঁপু নিয়ে ব্যস্ত। ভেঁপুর বাইরে, যে অনন্ত প্রকার আর অন্তহীন সৌন্দর্য্য আছে, মানুষ তা দেখতে চায় না। যে হিন্দু, সে খ্রিস্টানের সৌন্দর্য্য দেখতে চায় না। যে মুসলমান, সে নাস্তিকের সৌন্দর্য্য দেখতে চায় না। যে ভারতীয়, সে চীনার সৌন্দর্য্য দেখতে চায় না। যে তৃণমূল, সে বিজেপির সৌন্দর্য দেখতে চায় না। যে কমিউনিস্ট, সে ক্যাপিটালিষ্টের সৌন্দর্য্য দেখতে চায় না। যে বিজ্ঞান প্রেমিক, সে সাহিত্যের সৌন্দর্য্য দেখতে চায় না। যে গায়ক, সে শ্রোতার সৌন্দর্য্য দেখতে চায় না।

সকলেই তার আপন আপন ভেঁপু নিয়ে ব্যস্ত। অথচ শ্রোতা না থাকলে গায়কের অভিমান থাকবে কি? ধন বৈষম্য না থাকলে, কমিউনিস্ট তত্ত্ব বাঁচবে কি? আঁধার না থাকলে, আলোর সৌন্দর্য্য ফুটবে কি?

কখনো আমি শিল্পী, তো তুমি ক্যানভাস। কখনো তুমি শিল্পী, তো আমি ক্যানভাস। আমি তোমার ক্যানভাস। তুমি আমার ক্যানভাস। নদী আকাশের ক্যানভাস, আকাশও নদীর ক্যানভাস। আমরা সকলেই, একে অন্যের পরিপূরক।

এমন এক দিনের কথা ভাবো- এই পৃথিবীতে, তুমি কেবল একা! কেবলই একা! কোন মানুষ নেই, কোন পশু নেই, কোন বৃক্ষ নেই, কেবল তুমি একা! কদিন বাঁচবে তুমি? নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণায়, এক সপ্তাহ পরেই তুমি আত্মহত্যা করবে।

তুমি আছো বলেই, আমি বেঁচে আছি। তোমরা, আমার লেখা একটু আধটু পড়ো বলেই, রাতজেগে আমি সকাল সাতটা পর্য্যন্ত লিখতে থাকি। যেদিন তোমরা আমার লেখা পড়বে না, সেদিনই আমার লেখক সত্তার মৃত্যু ঘটবে।

তোমার জন্যই যদি আমার মধ্যে বাঁচার ইচ্ছে জাগ্রত, তাহলে তুমি আমার পূজ্য হবে না কেন? তুমি যদি বিধর্মী হও, তো তাতে আমার ক্ষতি কি? তুমি যদি চণ্ডাল বা পতিতা হও, তো তাতে আমার ক্ষতি কি? যেহেতু তোমার জন্য আমি বাঁচতে পারছি, সেহেতু তুমিই আমার ঈশ্বর। তুমি চণ্ডাল বা পতিতাও হলেও, তুমি কি আমার জীবনদাতা নও?

কৃষকের তৈরী শস্য খেয়ে বেঁচে আছি আমি। আবার কৃষককেই গন্ডমূর্খ বলে গালি দিচ্ছি আমি। তাহলে কেমন প্রকার পন্ডিত আমি? বিজ্ঞানের দেওয়া স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে, জীবনের প্রতিমুহূর্ত কাটাচ্ছি আমি। অথচ বিজ্ঞানকেই গালি করছি আমি। তবে কেমন ধার্মিক আমি? ভারতভূমিতে জন্ম আমার, অথচ ভারতকেই ছোট করছি আমি, তবে কেমন ভারত সন্তান আমি? যে মাতৃ গর্ভে জন্ম আমার, সেই মাকে অবহেলা করছি আমি। তবে কেমন সন্তান আমি? যে বান্ধবের কাঁধে ভর দিয়ে, বিপদ পেরিয়েছি আমি, তাকেই আমি বিপদে ফেলছি। তবে কেমন বন্ধু আমি?

চোখ খুললেই অন্তহীন সৌন্দর্য্য হে মানুষ
চোখ খুললেই অন্তহীন ভালোবাসা।

দয়া প্রেম সৌন্দর্য্য
আকাশে চকচক করে জ্বলছে। কিন্তু দেখে কে?
ত্যাগ তিতিক্ষা প্রেরণা
বাতাসে খলখল করে হাসছে। কিন্তু শুনে কে?
ভালোবাসা সাহচর্য্য
প্রতিনিয়ত চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু নেবে কে?

চোখ থাকতে অন্ধ কেন হে মানুষ
তুমি চোখ থাকতে অন্ধ কেন?

কান থাকতে
তুমি এতো বধির কেন?
হৃদয় থাকতে
তুমি এতো অবশ কেন?
যৌবন থাকতে
তুমি এতো নির্জীব কেন?
জীবন থাকতে
তুমি এতো মৃত কেন?

© অরুণ মাজী

Tuesday, May 22, 2018
Topic(s) of this poem: bangla,beauty,happiness,joy,life,love
COMMENTS OF THE POEM
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Close
Error Success