প্রেম পরিণয় পরিণতি (অরুণ মাজীর উপন্যাসের ক্ষুদ্র এক অংশ)(Prem Porinoy Porinoti) Poem by Arun Maji

প্রেম পরিণয় পরিণতি (অরুণ মাজীর উপন্যাসের ক্ষুদ্র এক অংশ)(Prem Porinoy Porinoti)

কলকাতায় ফিরে বুকটা কেমন খালি খালি লাগলো। ঈশঃ গ্রামে সময়টা, কেমন যেন হুশ করে কেটে গেলো!

কাকীমা দুদিনের জন্য গিয়ে, এক সপ্তাহ রয়ে গেলেন। দিদি আর দীপদা এসে যাওয়াতে, হৈচৈ আর মজাটা অনেক বেড়ে গেলো।তবে দুঃখ একটাই- স্কুলের কোন বন্ধুর সাথে দেখা হলো না। প্রায় সবাই এখন কলকাতায় কিছু না কিছু করছে। হাতে গুনা কয়েকজন, কলকাতার বাইরে। রাজা এখন ব্যাঙ্গালোরে। অনামিকা দিল্লীতে।

জীবনটা একটা স্রোত, আর আমরা- ছোট্ট ছোট্ট কচুরিপানা। আমরা কেউ কেউ একসাথে কিছুদিনের জন্য বড় হই। তারপর একদিন, উদ্দাম এক স্রোত আসে; আর সেই স্রোতে, আমরা আমাদের মতো করে, যে যেখানে পারি, ভেসে যাই। আবার আমরা নতুন জায়গায়, নতুন করে সাথী খুঁজে পাই। সেই নতুন জায়গায়, আবার কিছুদিন নতুন বন্ধুদের সাথে, একসাথে বেড়ে উঠি। আবার হয়তো উদ্দাম কোন স্রোত, আবার আমাদের অন্য কোথাও ভাসিয়ে দেয়। ভাঙা গড়া আর ভাঙা গড়া- এই তো মানুষের জীবন! শুধু মানুষই বা কেন? কচুরিপানা, পশু, পাখি- সবার জীবনই তাই!

বন্ধন কেবল ছিন্ন হওয়ার জন্য। কোন বন্ধনই চিরস্থায়ী নয়। বন্ধন জীবনে অটুট থাকলেও, মৃত্যুতে তা ছিন্ন হবেই। তবু আমরা বন্ধন ভালোবাসি, বন্ধনের জন্য জীবন পণ করে বসি। বন্ধন একদিন ছিন্ন হবে জেনেও, বন্ধনকে আমরা জীবনের মোক্ষ ভেবে বসি। সেজন্যই তো মানুষের বুকে এতো হাহাকার!

আমার সাথে তৃষ্ণার বন্ধনও তাই। আমরা নিশ্চিৎ- আমাদের বন্ধন, আমাদের জীবনে অটুটু থাকবে, কিন্তু তারপর? তারপর মৃত্যু একদিন, তার কালো চাদরে, আমাদের কাউকে বেঁধে নেবে। তৃষ্ণাহীন অমল বা অমলহীন তৃষ্ণা! কেমন হবে সেদিন? ভাবতে পারি না! ভাবতে গেলেই ডুকরে উঠে প্রাণ। আর্তনাদ করে উঠে আত্মা।

মৃত্যুর হাতছানি আমি কাছ থেকে দেখেছি। জীর্ণ শীর্ণ কঙ্কালসার তৃষ্ণা- ফ্যাকাশে মুখে হাসপাতালে শুয়ে। চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, চামড়া শুকিয়ে গেছে, ঠোঁট বিবর্ণ হয়ে গেছে। তৃষ্ণার সেই ছবি মানুষের মরণশীলতার প্রতিধ্বনি। ঈশ্বর মঙ্গলময়! তৃষ্ণাকে আমি ফিরে পেয়েছি।

কিন্তু এই পৃথিবীর কতো অমল যে, তার তৃষ্ণাকে ফিরে পায় না! তাদের কথা, আমি তো আগে কখনো ভাবি নি। আমি সৌভাগ্যবান, তবে তারা নয় কেন? তারা তো আমার চেয়ে বেশী পাপী নয়। কি সেই জিনিস, যা মানুষের এই ভাগ্য আর দুর্ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে? আমি ভাগ্যবান, তৃষ্ণার লিউকিমিয়ার ধরণটা খারাপ টাইপের ছিলো না। কিন্তু সেটা খারাপ টাইপের-ও তো হতে পারতো। অপেক্ষাকৃত ভালো টাইপের হলে, মানুষ বাঁচবে; আর খারাপ টাইপের হলে মানুষ মরবেই। বিজ্ঞানের আস্ফালন, সেই সব ভালো টাইপের লিউকিমিয়া হলে। কিন্তু যদি খারাপ টাইপের লিউকিমিয়া হয়, তখন বিজ্ঞানও তো অসহায়!

কে বা কি সেই শক্তি, যা এই নিষ্ঠুর খেলা নিয়ন্ত্রণ করে? মানুষ কি কখনো, তা জানবে? সেটাকে ঈশ্বর বলে মেনে নেওয়াতে হয়তো শান্তি আছে, কিন্তু ব্যাপারটা অজানা তো রয়েই গেলো।

মানুষ আর বিজ্ঞানের মহত্ব এইখানেই। তাদের ক্ষমতা হয়তো সীমিত, তবুও তারা হাল ছেড়ে দেয় না। আমার কাছে তাই- ঈশ্বরের অস্তিত্ব মহৎ, আবার বিজ্ঞানের অস্তিত্বও সমান ভাবে মহৎ। আমার কাছে ঈশ্বর আর বিজ্ঞান পরস্পরের শত্রু নয়। আমার কাছে ঈশ্বর আর বিজ্ঞান পরস্পরের মিত্র, পরস্পরের পরিপূরক।

হয়তো শত্রু বলে কিছুই নেই। শত্রুতা বোধহয় মানুষের একটা ভ্রম। একই জিনিসকে, দুই কোণ থেকে দেখার ফল। জলকে কেউ বলে ওয়াটার, কেউ বলে- পানি। একই সময়কে- কেউ বলছে দিন, কেউ বলছে রাত। কিন্তু সেই মুহূর্তটা, মহাবিশ্বে সকলের জন্যই তো এক। তাহলে তার দিন বা রাত- নাম কেন? সংঘাত সবসময় সীমিত দৃষ্টির ফল। যারা- সময় আর স্থানের, অনেকটা দেখতে পায়, তারা সৃষ্টির মধ্যে বিভেদও কম দেখে।

তুমি যদি মাটিতে থাকো- মাটিকে তুমি উঁচু নীচু এবড়ো থেবড়ো দেখো। কিন্তু তুমি যদি মাটি ছেড়ে অনেক উঁচুতে উঠে যাও- তখন সব মাটিকেই কেমন যেন একই রকম ধূসর বর্ণের মনে হবে। মানুষের প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো- তার অনুভূতির এই উচ্চতা বাড়ানো। কিন্তু আজকের শিক্ষা, বিভেদকে প্রকট করে। বিভেদকে মিলিয়ে দেয় না। তাই তো পৃথিবীতে এতো হানাহানি আর রক্তপাত। মানুষ যতদিন না পর্যন্ত তার অনুভূতির উচ্চতাকে বাড়াতে পারবে, ততদিন মানুষ পৃথিবীতে শান্তি আনতে পারবে না।

"কি ভাবছিস, অমল? "
মা, আমার মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

আমি যে এতো ভাবি, তা সকলকে, সবসময় বলা যায় না। মাকে তাই বললাম-
কিচ্ছু না, মা।

মা- "শোন, চৈতি যদি বিয়েতে খরচ করতে চায়, তো বাধা দিস না। ওর একটা মাত্র সন্তান, ওরও তো আহ্লাদ আছে। তবে তুই সব টাকা, ধার হিসেবে নিবি, আর তা তুই- আমার হয়ে, যতো তাড়াতাড়ি পারিস, শোধ দিবি। এঋণ তোর নয়, এ আমার নেওয়া ঋণ।"

আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম। কাকু একটু দূরে ছিলেন। উনি মায়ের উদ্দেশে বললেন-
"দিদি, তুমি এখনো আমাদেরকে আপন ভাবতে পারলে না! "

মা-"শ্রী, তোরা আপন বলেই তো, তোদের নিজস্বতাকে আমি শ্রদ্ধা করি।"

কাকু-"তোমাকে ঋণী ভাবলে, আমাদের কষ্ট হবে দিদি।"

কাকীমা রান্না ঘরে চা বানাচ্ছিলেন, উনি কফি টেবিলে, কাপ আর প্লেট রাখতে রাখতে বললেন-
"দিদি, তুমি আমাদের যৌথ পরিবারের মাথা। তুমি যা বলবে তাই সই। "

মা- "সে আমার ভাগ্য, চৈতি। তবে অমল আর তৃষ্ণা- ওদের দুজনকেই দায়িত্ব নেওয়া শিখতে হবে।"

কা (কাকীমা) - "ঠিক বলেছো দিদি। আমিও অমলকে বলেছি, ঢের হয়েছে আমার মা সাজা, এবার আমি তোদের মেয়ে সাজবো।"

মা- "শ্বাশুড়ি না থাকলে, আমি কবে বৃন্দাবনে চলে যেতাম! অমল এখন বড় হয়ে গেছে। ব্যাস, আমারও সংসারের পালা শেষ।"

কাকু- "কেন? ছেলে- বৌয়ের সাথে থাকবে না? "

মা-"সে ইচ্ছে থাকলে, ছেলেকে মূর্খ রাখতাম। এখন- আমি ভিটে আমার ছাড়বো না। আর আর্মিও, আমার গ্রামে, হাসপাতাল কখনো বানাবে না। কাজেই অমল আমার থেকে দূরেই থাকবে।"

মা একটু থেমে, কাকুর দিকে চেয়ে বললো-
"সংসারে থাকলে, পাঁকাল মাছের মতো থাকতে হয় শ্রী, তাতে যন্ত্রণা কম হয়। নইলে জীবনটা জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যায়।"

কাকু-"তুমি ভালো করে, চৈতিকে একথা বলো। তিনমাস মেয়ে কোল ছাড়া, তাতেই ওর ডিপ্রেশান হয়ে গেছে।"

কা-"কেন, মেয়েকে কোলে রাখতে চাওয়া অন্যায় নাকি? "

কাকু-"নিশ্চয় অন্যায়। স্নেহ ভালোবাসা অধিকার নয়, চৈতি। স্নেহ ভালোবাসা শুধু দেওয়া, নিঃশর্ত দেওয়া। তুমি যদি শর্ত চাপিয়ে ভালোবাসা দাও, সে তো আর ভালোবাসা হলো না, সে হলো তোমার আলু চাষ।"

মা-"আমাদের পাখি উড়ে গেছে, চৈতি। এখন আমাদের শুধু আকাশ পানে চেয়ে, প্রতীক্ষা করা-কখন সে পাখি পথ ভুলে, আমাদেরকে একটু ছুঁয়ে যায়!

যা রে পাখি যা
আকাশে, ডানা মেলে উড়ে যা।
উড়ে যা কোন অন্তহীন আকাশে
উড়ে যা কোন অজানা নিরুদ্দেশে
উড়ে যা কোন স্বপ্ন ভরা স্বপ্নদেশে।

আমার জন্ম তোর মুক্তির তরে পাখি
তুই তাই উড়ে যা।
পরাণ আমার কাঁদে কাঁদুক
বুক আমার ফাটে ফাটুক
তবুও তুই উড়ে যা।

স্নেহ দিলে, আঘাত পেতে হয়।
বন্ধন গড়লে, ছিন্ন বন্ধনের কান্না কাঁদতে হয়।
বুকে ধরলে-
বুক খালি করে, শূন্যতা আঁকড়ে ধরতে হয়।

যতো নিবিড় ভালোবাসা, ততো বেশী চোখের জল।
কে জানে, ভালোবাসা হয়তো অশ্রুর গর্ভে-ই জাত!

অশ্রু গর্ভে জাত আমি
নাম আমার ভালোবাসা
স্বপ্ন দিয়ে রাঙা আমি
আমি ভাঙি সকল আশা।

রমণীর উচ্ছ্বাস আমি
আমি পুরুষের উন্মাদনা
শিশুর জীবন আমি
আমি প্রেমিকের যন্ত্রণা।
মাতার অশ্রু আমি
আমি পিতার সমবেদনা
বান্ধবের বন্ধন আমি
আমি ঈশ্বরের চেতনা।

আমি-
আশা হতাশা
বিশ্বাস নিরাশা
ভয় ভরসা
অশ্রু গর্ভে জাত আমি
নাম আমার ভালোবাসা।

চৈতি, জীবনটা তাই পাঁকাল মাছের মতো কাটিয়ে দে। সংসারের পাঁকে থাকবি, অথচ সংসারের আসক্তির পাঁক যেন তোকে স্পর্শ না করে।দেখবি, তাহলে কোনদিন ব্যথা পাবি না তুই।"

আমি নীরব। আমি দেখলাম, কাকু সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। আর কাকীমার চোখ, জলে চকচক করছে। মা-ই কেবল ধীর স্থির আর শান্ত। মা যখন বাবাকে হারায়, মা তখন যুবতী। আমি তখন তিন বছরের, আর দিদি পাঁচ বছরের। নিঃসঙ্গতা আর অর্থাভাব, মা-কেঅনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। সেই যন্ত্রণার আগুনে পুড়তে পুড়তে, মা এখন খাঁটি সোনা। এখনও যন্ত্রণা মা-কে হয়তো ভেতরে ভেতরে আলোড়িত করে, কিন্তু যন্ত্রণা মাকে আর উন্মাদ করতে পারে না। মা সংসারে থেকেও, বড় এক সন্ন্যাসিনী।

আমার মা- আমার কাছে এক সূর্য। যার আলোতে আমি আলোকিত হই। আমার মা- আমার কাছ এক ধ্রুবতারা, যারা অবস্থানে আমি পথ নির্দেশ পাই। আমার মা- আমার কাছে এক চন্দ্র, যার হাসিতে আমার আত্মা তৃপ্তি পাই। আমার মা- আমার কাছে এক মহাবিশ্ব, আমার সকল অস্তিত্বের কারন।

মা জিজ্ঞেস করলো-
"শ্রী, তোরা বিয়ের ব্যাপারে কি ভাবলি? "

কাকু-"তুমিই বলো দিদি, ডিসেম্বর নাগাদ কোন ভালো দিন আছে কিনা! "

মা-"সব দিনই ভালো দিন। যে কোন একটা দিন ঠিক করলেই হয়।"

কা-"ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে, তৃষ্ণা আসবে। তারপর ২১ তারিখে একটা দিন আছে। "

মা-"তবে তাই হোক। বিয়েটা গ্রামেই হবে তো? "

কাকু-"দিদি, তুমি যদি চাও, তো তাই হবে। চৈতি তুমি কি বলো? "

কা-"সেই ভালো। তারপর কলকাতায় একটা রিসেপশান করলেই হলো। অমল তোর কি মত? "

আমি হাসলাম, বললাম-
আপনারা যা ঠিক করবেন, তাই ঠিক। তবে আর্মিতে, ছুটি পাওয়া একটু গোলমেলে।

একটু থেমে, মাকে আমি বললাম-
চলো মা, তোমাদেরকে নিয়ে একটু ঘুড়ে আসি। ভাবছি- তোমাদেরকে কিছু শাড়ি কিনে দিই।

মা হাসলো, খুশি হয়ে বললো-
তোর প্রথম রোজগারের টাকা! আমরা এক্ষুনি যাবো।

কাকীমা বললেন-
কি মজা! আজ অমল আমাদেরকে শাড়ী দেবে! চলো, চলো। এক্ষুনি চলো।......................

© অরুণ মাজী
Painting: Andrew Atroshenko

প্রেম পরিণয় পরিণতি (অরুণ মাজীর উপন্যাসের ক্ষুদ্র এক অংশ)(Prem Porinoy Porinoti)
Thursday, November 2, 2017
Topic(s) of this poem: life,love,mother,passion
COMMENTS OF THE POEM
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Close
Error Success