স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে কার্গিল যুদ্ধ আর ভারতীয় সেনার আত্মত্যাগকে স্মরণ করে অরুণ মাজীর উপন্যাস
-----------------------------------------------------------
কর্ণেল সিং আমাকে, মিলিটারি পুলিশের চেক পোস্টে নামিয়ে দিলেন। চেয়েছিলেন উনি, আমাকে আমার ইউনিটে পৌঁছে দিতে। কিন্তু কনভয় ছেড়ে উনি একলা যেতে পারবেন না। কারণ, একলা যাওয়ার নিয়ম নেই। সুরক্ষার জন্য, সবাইকে কনভয়ের সাথে যেতে হয়।
গাড়ি থেকে নেমে ওনাকে স্যালুট করলাম আমি। আমাকে স্যালুট করতে দেখে, ঠোঁটের কোণে হাসলেন উনি। তারপর আমাকেও প্রতি-স্যালুট করলেন উনি।
ওনার গাড়ি চলতে শুরু করলো আবার। সেই দিকে, বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম আমি। গাড়িটা অদৃশ্য হতেই, মিলিটারি পুলিশের অফিসে এলাম আমি। অফিসে ঢুকে, আমার ইউনিটে ফোন করলাম। ফোন শেষে, অফিসে রাখা একটা প্ল্যাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়লাম।
এবার আমার অপেক্ষার পালা। অন্তত দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। এখান থেকে আমার ইউনিটের দূরত্ব এক ঘন্টারও বেশি। গাড়ি তৈরী হয়ে আসতে আসতে, দেড় ঘন্টা লাগবেই।
অথচ কিছু করার নেই। তাই অফিসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে দেখলাম। চারপাশটা বেশ থমথমে। কেমন যেন এক ভয়ের সঙ্কেত। হটাৎ দুম দুম করে কিছু বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এলো। কান পেতে ভালো করে শুনার চেষ্টা করলাম। নাহঃ কাছাকাছি নয়। বেশ দূরে হবে। নাহঃ কিছুই বদলায় নি এখানে। এখনও বেশ যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব চারিদিকে।
রাস্তার উপর এই চেক পোস্ট। কংক্রিট দিয়ে তৈরী বেশ সংকীর্ণ এক বাঙ্কার। আর রাস্তার ধার ঘেঁষে, বয়ে গেছে পাহাড়ি এক নদী। নদীর উপর দিয়ে, ব্রিজ পেরিয়ে এলেই, এই চেকপোস্ট।
এবার নদীটার দিকে চেয়ে দেখলাম আমি। নাহঃ জল খুব বেশি গভীর নয়। কিন্তু স্রোত আছে বেশ। নদীর চর, ছোট বড় পাথরে ঢাকা। আর চর শেষে, সবুজ বিস্তীর্ণ ভূমি। বিস্তীর্ণ সেই উপত্যকার উপর, ছোট ছোট কিছু বাড়ি। আর ছোট ছোট চাষের জমি।
অদূরে একদল গরু আর ভেড়া চড়ছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে কয়েকজন মানুষ। সেই দিকে চেয়ে রইলাম আমি। দেখি, মধ্যবয়স্ক এক লোকের সঙ্গে রয়েছে এক জন মহিলা। সঙ্গে ছোট একটা মেয়ে। হয়তো গোটা একটা পরিবার হবে।
বেশ কঠিন জীবন এদের। জীবিকা বলতে, ছোট ছোট জমিতে চাষ। আর সেই সঙ্গে এই পশুপালন। নিরীহ শান্ত মানুষ এরা। কারও সঙ্গে কোন শত্রুতা নেই এদের। অথচ এই যুদ্ধে, এরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ছোট মেয়েটির এ স্কুলে থাকার সময়। অথচ ও এখন বাবা মায়ের সাথে ভেড়া চড়াচ্ছে!
মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। এমন সময় চেক পোস্টের সুবেদার আমার কাছে এলেন। প্রথমে হাসলেন উনি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন-
'চা খাবেন সাহেব?
ওনার হাসির উত্তরে, হাসলাম আমিও। তারপর হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়লাম।
সুবেদার সাহেব চলে গেলেন। কিন্তু এক মুর্হুর্ত পরেই, চা আর পকোড়া হাতে ফিরে এলেন উনি।
বেশ আশ্চর্য হলাম। রাস্তায় বসে রয়েছি অপরিচিত মানুষদের সাথে, অথচ এখানেও যত্ন পাচ্ছি আমি। কি আশ্চর্য! তাই না?
আসলে, গোটা ইন্ডিয়ান আর্মি, একটা বড় পরিবার। আপনি যেখানেই যান না কেন, আর্মির অন্য সদস্যরা আপনার দেখাশুনা করবেই। সঙ্গে কেবল, আপনার আইডেন্টিটি কার্ড থাকতে হবে।
চা আর পকোড়া আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে উনি জিজ্ঞেস করলেন-
'ছুটি থেকে ফিরছেন? বাড়ির সবাই ভালো আছে আপনার? '
অবাক হলাম আমি। কথাগুলো উনি এমন করে জিজ্ঞেস করলেন, যেন উনি আমার পূর্বপরিচিত মানুষ। তাই হাসলাম আমি। বললাম-
হ্যাঁ। আপনি শেষ কবে ছুটিতে গেছিলেন?
প্রশ্নটা শুনে একটু যেন দমে গেলেন উনি। ওনার চোখে বিষাদের ছায়া ঘনিয়ে এলো। তবুও যেন হাসার চেষ্টা করলেন উনি। বললেন-
'দেড় বছর আগে। যুদ্ধ শুরুর আগে।'
ছুটি পাচ্ছেন না?
'নাহঃ সাহেব। লোকজনের খুব অভাব।'
গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। আমাকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখে উনি বললেন-
'কি আর করবো সাহেব! আমাদের জীবনই এরকম! '
হটাৎ চেকপোস্টের ভেতরে চোখ গেলো আমার। দেখি, সেখানে বেশ কিছু বিছানা আর বাসন পত্র। আমাকে সেদিকে চেয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন-
'আমাদের এখানেই খাওয়া দাওয়া, এখানেই শোয়া। আর সামনে যে নদীটা দেখছেন, ওখানে স্নান।'
ভাবলাম, কজন ভারতীয় নাগরিক জানে, এদের কঠিন এই জীবনের কথা? এদের ত্যাগের কথা! পাহাড়ি রাস্তা আর নদীর ধারে, কংক্রিটের ছোট্ট এক বাঙ্কারে বাস এদের। বেশ অরক্ষিত এই জায়গা। যে কোন মুহূর্তে উগ্রবাদীর হামলা হতে পারে এদের উপর। যে কোন মুহূর্তে প্রাণ যেতে পারে এদের।
অথচ এই বিপদ বুকে নিয়ে, বছরের পর বছর কাটাচ্ছে এরা। নিজ স্ত্রী পুত্র কন্যাকে বছর বছর চোখে দেখতে পায় না এরা। এমনকি তাদের সাথে কথা বলার সুযোগও ঘটে না এদের। হয়তো এমন প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ এরা, যেখানে কোন ইলেক্ট্রিসিটি নেই। ফোন লাইন নেই।
মাইনের কতকগুলো টাকা দিয়ে কি, এদের এই ত্যাগকে কখনো কেনা যায়? নাহঃ যায় না। তবুও, তাই ঘটছে। পৃথিবী জুড়ে তাই ঘটছে। গুটিকয় মানুষের অর্থ আর ক্ষমতার লোভের জন্য, সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে।
হটাৎ সুবেদার সাহেব বাইরের দিকে চেয়ে দেখলেন। তারপর আমার উদ্দেশে বললেন-
'সাহেব, আপনার গাড়ি এসে গেছে।'
চকিতে, বাইরের দিকে চেয়ে দেখলাম আমি। দেখি, মকর সিং। আমার প্রিয় মকর সিং। হাসতে হাসতে আমার দিকে ছুটে এলো ও। আমার কাছে এসে, আমাকে স্যালুট করে মকর সিং বললো-
'সাহেব, গাড়ি তৈরী।'
হাসলাম আমি। ওকে প্রতি-স্যালুট না করে, বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
আসলে, মকর সিং আমার ছায়া সঙ্গী। যুদ্ধ বিধস্ত এই বিপদ সঙ্কুল অঞ্চলে, কতবার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে ও! সর্বদা ছায়ার মত আমাকে অনুসরণ করে ও। তাই ওকে দেখে, খুশিতে প্রাণ ভরে গেলো আমার।
সুবেদার সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠলাম আমি। মকর সিংও গাড়িতে উঠে বসলো। মকর সিংয়ের কাঁধ ছুঁয়ে আমি বললাম-
চল, ঘরে ফিরে যাই আমরা।
ঘরই বটে। বছরের পর বছর কাটাচ্ছি যে জায়গায়, তাকে ঘর বলবো না? হোক না সে রক্তক্ষয়ী প্রাণঘাতী যুদ্ধক্ষেত্র! হোক না সে ভবিষ্যতের শ্মশানভূমি!
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem