মাঝে মাঝে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি- 'কে আমি? কে? '
আমি কি কমিউনিস্ট? ক্যাপিটালিস্ট? ফ্যাসিস্ট? সোস্যালিস্ট? ন্যাশনালিস্ট? ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার মনে হয়- আমি এদের কোনোটাই নই। আমি হলাম- আনার্কিস্ট (Anarchist) । প্রলয়বাদী। তার মানে কি এই যে- আমি সব কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাই? আমি কি মানুষ আর মানুষের সভ্যতাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাই?
না। আমি সেই ধরণের প্রলয়বাদী নই। আমি হলাম 'চিন্তার প্রলয়বাদী' (Thought Anarchist) । আমি এ ধরণের কেন? আমি তোমাদেরকে সত্যের বহুত্ব সম্পর্কে অনেক বলেছি। সত্যের বহুত্ব ব্যাপারটা কি রকম?
ধরো, আজকের 'সকাল-টা' কেমন? তুমি বললে- উষ্ণ। কিন্তু আমি বললাম- নাতিশীতোষ্ণ। কে ঠিক? তুমি অথবা আমি? সঠিক উত্তর কে ঠিক করবে? কে, কি ভাবে ঠিক করবে? হয়তো (হয়তো) বিজ্ঞানীরা বলবে- ৩০ ডিগ্রীর উপর হলে উষ্ণ, আর তা নাহলে নাতিশীতোষ্ণ। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এই ৩০ ডিগ্রীর উচ্চতাটা, কোন যুক্তিতে, কি ভাবে নিয়ে এলো? তার কোন উত্তর নেই। আমরা দুজনে, এই নিয়ে হাতাহাতি লড়ে পরস্পরকে খুন করতে পারি। কিন্তু আমরা কোন উত্তর-ই পাবো না।
কাজেই কার উত্তরটা ঠিক? তোমার অথবা আমার? উত্তরটা হলো- তোমার শিক্ষা আর পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তুমি ঠিক। আর আমার শিক্ষা আর পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আমিও ঠিক। একটাই সকাল। কিন্তু এখানে দুটো- ঠিক উত্তর। এই হলো আমার সত্যের বহুত্ববাদ।
আমার ধারণা, মানুষের উচিৎ- সত্যের এই বহুত্বকে শ্রদ্ধা করা। তা না হলে মানুষ- লড়াই করে, পরস্পরকে খুন করে, নিজেদেরকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। আজকের পৃথিবীতে- ধর্ম, দেশ বা দল ইত্যাদির মধ্যে যে বিবাদ; তার কারন হলো মানুষ সত্যের এই বহুত্বকে শ্রদ্ধা করে না। এ বলছে আমার ধর্ম বড়, তো ও বলছে আমার ধর্ম বড়। কে, কিভাবে ঠিক করবে, কার ধর্ম বড়? কোন মানুষের সেই উত্তর জানা নেই। কাজেই ব্যবহারিক সমাধান হলো- সকলের ধর্মই তাদের নিজেদের কাছে বড়। সত্যের এই বহুত্ব যদি আমরা মেনে চলি- তাহলে কিন্তু আর ধর্মে ধর্মে সংঘাত হবে না।
আমার দ্বিতীয় তত্ত্ব হলো- সত্যের সাময়িকতা। একই সত্য চিরদিনের জন্য সত্য থাকে না। তেরো মিনিট তিপান্ন সেকেন্ড আগে, মালবিকার ঠোঁট আমার খুব মিষ্টি লেগেছিলো। এখন আমি ক্লান্ত আর উদ্বিগ্ন; মালবিকা তার ঠোঁট আমার প্রতি বাড়িয়ে দিলে, তা আমার এখন ছুঁতেও ইচ্ছে করে না। মালবিকার টসটসে চেরী ঠোঁট, সেই একই রকম টসটসে চেরী ঠোঁট-ই আছে। কিন্তু আমার- তা আর এখন মিষ্টি লাগছে না। কেন? মিষ্টি অনুভব করার ক্ষমতা, এখন আমার মধ্যে বদলে গেছে। আর সে কারনেই- তেরো মিনিট তিপান্ন সেকেন্ড আগের সেই সত্য, এই মুহূর্তে আর সত্য নয়। সময়ের সঙ্গে সত্য বদলে যায়।
আমার তৃতীয় তত্ত্ব হলো- সত্যের আপেক্ষিকতা। একই মায়ের যমজ সন্তান। কিন্তু সেই মা- একজনকে একটু বেশী পক্ষপাতিত্ব করে। তুমি সেই মাকে জিজ্ঞেস করো- 'তুমি ছোটকা-কে বেশী ভালোবাসো কেন? ' দেখবে- সেই মায়ের সঠিক উত্তর জানা নেই। সেই মা উত্তর দিতে কেমন যেন আমতা আমতা করবে। কেন এমন হয়? আমাদের অনুভব- বিভিন্ন জীব, বা বিভিন্ন বস্তুর জন্য ভিন্ন কেন? তার সঠিক উত্তর কারও জানা নেই। একে আমি বলি- সত্যের আপেক্ষিকতা। তুমি যাকে সত্য বলছো, সেটা আসলে কি? সেটা সেই জিনিসটার প্রতি তোমার অনুভব। যেহেতু অনুভব আপেক্ষিক, সেহেতু সত্যও আপেক্ষিক।
তাহলে দেখছো? তোমরা সত্য নিয়ে এতো লড়াই করো, অথচ সেই সত্য-টাই কেমন যেন চরিত্রহীন বেশ্যা। ক্ষনে ক্ষনে সে তার চরিত্র বদলায়।
আমরা কাকে ঈশ্বর বলি? যিনি সর্ব্বশক্তিময়, সর্ব্বজ্ঞ, সর্ব্বত্রবিরাজমান। এমন কেউ থাকতেই পারেন, আবার নাও থাকতে পারেন। কেউ যদি বিশ্বাস করে, তো- ঈশ্বর আছে। আবার কেউ যদি বিশ্বাস না করে, তো- নেই। কেন? ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমান করার- সর্ব্বজন গ্রাহ্য (গ্রহণযোগ্য) কোন পথ নেই। এই নিয়ে, লড়াই করার কোন অর্থ আছে কি? সত্যের বহুত্ব উত্তর দেবে।
তাহলে চরম বা পরম সত্য বলে কি কিছু নেই? থাকতেই পারে। তবে কোন মানুষ, তা কোনদিন জানবে না। সে জন্যই বোধহয় অনেক ধর্ম বলে- যে ঈশ্বর-ই পরম বা চরম সত্য। তার অর্থ কি? সত্য- মানুষের হাতের 'মোয়া' নয়।
এই কারনেই আমি 'চিন্তার প্রলয়বাদী' (Thought Anarchist) । ব্যাপারটা কেমন? পৃথিবীতে যা কিছু ধ্যান ধারণা বর্তমানে আছে তাদের কিছু ভালো, আবার কিছু খারাপ। তুমি সেগুলো কি ভাবে বুঝবে? তোমার নেতা বলেছে বলে? তোমার ধর্মগুরু বলেছে বলে? তোমার নেতা বা ধর্মগুরু যে ঠিক, তা কে বলেছে? সে কার থেকে শিখেছে? তার শিক্ষক যে ঠিক, তা কে বলেছে?
সেজন্য আমি ধরে নিই- যে সবই মিথ্যে। আমি এবার নিজে নিজে- আমার জীবন, শিক্ষা, আর চিন্তা দিয়ে ধীরে ধীরে বোঝার চেষ্টা করবো- কোনটা সত্যি, আর কোনটা মিথ্যে। এ জন্যই আমি কোন নেতাকে বিশ্বাস করি না, কোন ধর্মগুরুকে বিশ্বাস করি না, কোন গ্রন্থকে বিশ্বাস করি না ইত্যাদি। আমার কাছে- এরা সবাই এক শূন্যস্থান। আর আমি এক ন্যাংটো শিশু। আমি সব কিছু জিবে ঠেকাবো, চিমটে চিমটে দেখবো, বঁটি দিয়ে কাটবো, পেরেক দিয়ে ঠুকবো; তবে আমি বিশ্বাস করবো।
আমি প্রতি মুহূর্তে নতুন হচ্ছি। আমার পুরানো সংস্করণ, আর আমি নই। সকালে আমি যা লিখেছি, বিকেলে আমি তা বিশ্বাস করি না। কেন? কারন প্রতি মুহূর্তে আমার অনুভব বদলে যাচ্ছে, শিক্ষা বদলে যাচ্ছে, অভিজ্ঞতা বদলে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে একটা করে নতুন নতুন অরুণ মাজী তৈরী হচ্ছে। এই কারনেই আমি- আমার ধারনা যে সত্য (বা একমাত্র সত্য) , তাও আমি বিশ্বাস করি না। আমি কিছুই বিশ্বাস করি না, কাউকে বিশ্বাস করি না। আমি মালবিকার চেরী লাল ঠোঁটকেও বিশ্বাস করি না। আমি এক ভয়ঙ্কর (চিন্তার) প্রলয়বাদী (Thought Anarchist) ।
হে মানুষ, আমার লেখা তোমরা কাটা ছেঁড়া করো, কিন্তু তাই যে সত্য (বা একমাত্র সত্য) তা কোনদিন বিশ্বাস করো না।
© অরুণ মাজী
Painting by Iman Maleki
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem