জীবনের সঙ্গে যন্ত্রণা, আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে আছে। ঠিক চুলের বিনুনির মতো। এদেরকে তুমি আলাদা করতে পারবে না। জীবনে বেঁচে থাকার, যে দাম মানুষ দেয়, তা হলো যন্ত্রণা! যন্ত্রণা থেকে লোকে লুকোতে পারে, কিন্তু পালাতে পারে না। কিন্তু যন্ত্রণার হুলকে, মানুষ সহজেই ভোঁতা করে দিতে পারে।
সেই ভোঁতা করার পদ্ধতি, বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম! একজন সাধু ভাবে- পার্থিব কিছু থাকা মানেই বেশী যন্ত্রণা! তাই সে ন্যাংটো ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সব মানুষই তো আর ন্যাংটো ঘুরে বেড়াতে পারে না। তা কাম্যও নয়। তাহলে চাষ করবে কে? চিকিৎসা করবে কে? দেশ চালাবে কে?
তোমার পদ্ধতি, তোমাকে আবিষ্কার করতে হবে। আমি তোমাকে কিছু ইঙ্গিত বা ধারণা দিতে পারি। কিন্তু যে ওষুধে আমার রোগ সেরেছে, সে ওষুধে, তোমার রোগ নাও সারতে পারে। যেহেতু- প্রত্যেকের জীবন আলাদা, চরিত্র আলাদা, পরিস্থিতি আলাদা। তাই তাদের রোগ আলাদা, আর তার ওষুধও আলাদা।
এজন্যই আমি, কারও শেখানো বুলি বা মুখস্থ বিদ্যাতে বিশ্বাস করি না। আমি তাই চাই- মানুষ নিজে নিজে ভাবতে শিখুক। তখনই সেই মানুষ- নিজের রোগের ওষুধ, নিজে খুঁজে নিতে পারবে। দুঃখের বিষয়, আজকের মানুষ গভীর ভাবে ভাবতে ভুলে যাচ্ছে। আজকাল শুধু নাটক বাজি। যে একটা বিষয়ের, কিছুই বোঝে না, সেও পন্ডিত হওয়ার ভান করে! দু পাতা পড়লেই কি জ্ঞানী হওয়া যায়? রামকৃষ্ণ মুখ্যু ছিলেন, কিন্তু তিনি কতো জ্ঞানী ছিলেন, বলো তো? আমার মা মুখ্যু, কিন্তু তাকে কোনদিন- হা হুতাশ করতে বা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে দেখিনি। আর আমি, এলোপাথাড়ি ভুল করি। কেন? কারন- আমার মা, মূর্খ হয়েও জ্ঞানী; আর আমি পন্ডিত হয়েও গন্ডমূৰ্খ!
যা বলছিলাম- যন্ত্রণার থোঁতা মুখ কিভাবে ভোঁতা করা যায়? অনেকে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে, মদ বা গাঁজা খায়। যতক্ষণ তারা নেশাগ্রস্ত, ততক্ষন তারা যন্ত্রণা ভুলে থাকে! কিন্তু নেশা কাটলেই, আবার যেই কে সেই। তার চেয়েও বড় সমস্যা হলো, নেশা তাদের জীবনে- আরও বড়, আরও বেশী যন্ত্রণা আনে।
কিন্তু এমন নেশাও তো আছে, যাতে নেশা হয়; কিন্তু কোন সমস্যা হয় না! বরং যন্ত্রণা দিব্যি ভুলে থাকা যায়! কি সেই নেশা?
কখনো মন দিয়ে, গীতা দত্ত বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান শুনেছো? কি মনে হয় তখন? তুমি দিব্যি নিজেকে ভুলে যাও, তোমার নিজের যন্ত্রণা ভুলে যাও। গান যেমন- তোমাকে নেশাতে ডুবিয়ে, তোমার যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিতে পারে, ঠিক তেমনি- কবিতা, আঁকা, খেলাধূলা, আড্ডা মারা, দর্শন আলোচনা ইত্যাদিও তাই পারে। গান, কবিতা, দর্শন ইত্যাদির মধ্যে কি এমন আছে, যা তোমাকে যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়?
এর উত্তর পেতে হলে, তোমাকে এ লেখা শুধু পড়লে হবে না, অনুভব করতে হবে? কি সেই অনুভব?
উৎস সন্ধান। হ্যাঁ উৎস সন্ধান। তোমার উৎস সন্ধান। ভালো কবিতা, বা ভালো গান, বা ভালো দর্শনের প্রশ্ন- তোমাকে খুব সহজ, অথচ কঠিন সব প্রশ্নের সম্মুখীন করে। একটা বিরহের গান শুনছো, আর তোমার মনে পড়লো, তোমার পূর্ব প্রেমিকের কথা। তোমার চোখে জল এলো! চোখের জলে মানুষের যন্ত্রণার নিরাময় হয়। তুমি তখন হাল্কা অনুভব করো। তোমার মধ্যে, বহু বছরের জমাট বাঁধা যন্ত্রণা, তখন খাঁচা থেকে মুক্তি পায়।
কখনো নিজেকে জিজ্ঞেস করেছো- কাঁদলে বুকটা এতো হাল্কা হাল্কা লাগে কেন? বা তুমি কাঁদলে কেন? বা গান শোনার সময় তোমার পূর্ব প্রেমিককে মনে পড়লো কেন? এই সব প্রশ্নের মাধ্যমে তুমি নিজে, নিজেকে জানবে। আরও সব প্রশ্ন, যেমন- জীবনে যন্ত্রণা কেন? মানুষ- মানুষ কেন? এ যৌবন কেন? এ জীবন কেন? এ মরণ কেন? আমি কোন পথে চলেছি? এ কি ঠিক পথ? এ পথের শেষ কোথায়? - ইত্যাদি সব প্রশ্ন- তোমাকে, তোমার নিজের উৎসের কাছে পৌঁছে দেবে।
দার্শনিক হতে গেলে, শিক্ষা লাগে না; কেবল সূক্ষ্ম অনুভূতিকে জাগ্রত করতে হয়। কথা কম বলো; শোনো বেশী, দেখো বেশী, অনুভব করো বেশী। তুমি কখনো নিজের শ্বাস প্রস্বাসকে অনুভব করেছো? বলো তো- শ্বাস-প্রশ্বাস কি, এবং কেন? কয়েক বছর আগে, আমি লিখেছিলাম-
শ্বাসে নিলে শান্তি,
প্রশ্বাসে পাবে প্রশান্তি।
শ্বাসে নিলে বিষ
তুমি জ্বলবে অহর্নিশ!
এখন তোমার চোখ বন্ধ করো। খুব ধীরে, শ্বাসের মধ্যে এখন একটু শান্তি নাও। তারপর তুমি নিঃশ্বাস ছাড়ো। কি অনুভব করছো? প্রশান্তি। এই হলো মেডিটেশান। এই হলো তপস্যা। এই হলো Breathing Exercise, এই হলো নিরাময়ের পদ্ধতি।
কবিতা কেবল কবিতা নয়। গান কেবল গান নয়। এরা মানুষের যন্ত্রণার নিরাময়। তোমাকে গান আর কবিতার মধ্যেও, কিভাবে নিরাময় পেতে হয়, তা শিখতে হবে। এখন থেকে মুখ সেলাই করে দাও। অনাবশ্যক কথা বলো না। যে কথা অন্যের মুখে হাসি না আনে, সে কথা তুমি বলো না।
তোমরা ভালো থেকো। আমাকে প্রশ্ন করো, আলাদা ভাবে হয়তো উত্তর দিতে পারবো না, কিন্তু আবার একটা লেখার মাধ্যমে উত্তর দেবো।
© অরুণ মাজী
Painting: Henri-Guillaume-Schelesinger
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem