মনে পড়ে- কিভাবে, কি সাংঘাতিক উৎকণ্ঠা নিয়ে, মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলের জন্য তোমরা অপেক্ষা করেছিলে? তখন এক একটা দিন মনে হয়েছিলো এক একটা বছর। সঙ্গে- ভয়, আর যন্ত্রণা। কেউ কেউ আবার শান্ত মনে ধৈর্য্য ধরেছিলে। তারা কিন্তু যন্ত্রণা বেশী ভোগ করে নি। কেন?
যা হওয়ার, তা হবে। কর্ম্ম তোমার হাতে, ফল কিন্তু তোমার অদৃষ্টের হাতে। কেউ বা বলে- ঈশ্বরের হাতে। ঈশ্বরে বিশ্বাস করো বা না করো- কথাটা হলো, তোমার কর্ম্মের ফল- তোমার হাতে নেই। তবে তোমরা জিজ্ঞেস করবে- তাহলে কর্ম্ম করে লাভ কি? কারন এও সত্য যে- তুমি তোমার কর্ম্মের অনুসারী ফল পাবে। তুমি ধান বুনলে ধান পাবে, গম তো আর পাবে না।
ব্যাপারটা একটু গোলমেলে মনে হচ্ছে, তাই না? জীবনে কিছু জিনিস আছে, যার উপর তোমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে; আর কিছু জিনিস আছে, যেগুলোর উপর তোমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আবার কিছু জিনিস আছে, যার উপর তোমার আংশিক নিয়ন্ত্রণ আছে। একজন বিচক্ষণ মানুষ- তার পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়- সেখানেই নিয়োগ করে, যেখানে তার নিয়ন্ত্রণ আছে। আর যেসব কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ নেই, সে সব জিনিস নিয়ে সে কখনো উদ্বেগ করে না।
পরীক্ষা দেওয়াটা ছিলো তোমার হাতে। কিন্তু ফল বেরোনোর তারিখ; বা পরীক্ষক- দয়ালু হবে কি নিষ্ঠুর হবে, তা তোমার হাতে ছিলো না। কাজেই পরীক্ষার ফল নিয়ে উৎকণ্ঠা, তোমার যন্ত্রণাই কেবল বাড়িয়েছিলো, তোমাকে ভালো কিছু দেয় নি। পরীক্ষার প্রস্তুতি ছিলো তোমার নিয়ন্ত্রণে। তাই তাতে যারা মনোনিবেশ করেছিলো, তারা প্রায় সকলেই ভালো ফল করেছিলো।
নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার এই গন্ডী জানলে, এবং জীবনে তা প্রয়োগ করলে, তোমার জীবনে যন্ত্রণা অনেক কমে যাবে। নতুবা, তোমার নিয়ন্ত্রণে নেই, সেসব জিনিস নিয়ে, তুমি যদি অহেতুক উদ্বেগ করো, তা তোমাকে কেবল যন্ত্রণাই দেবে। শান্তি কোনদিন দেবে না।
নাচতে যে কেউই পারে। কিন্তু যারা নাচের ব্যাকরণ জানে, তারা ভালো নাচে। জীবন সকলেই যাপন করে, কিন্তু যারা জীবনের ব্যাকরণ জানে- তারা অপেক্ষাকৃত সুখ আর শান্তিময় জীবন যাপন করে। সে জন্য তোমাকে, জীবনের ব্যাকরণ শিখতে হবে।
ধৈর্য্যে নিরাময়, অধৈর্য্যে যন্ত্রণা। যা হওয়ার, তা তো হবেই। তাহলে উৎকণ্ঠা কেন? অধৈর্য্য কেন? তুমি যদি শান্ত থাকো, তাহলে তুমি যা ভাববে বা করবে; সে সবই- তুমি খুব সুন্দর ভাবে করবে। কিন্তু তুমি যদি উদ্বিগ্ন থাকো, তাহলে- তোমার মস্তিস্ক কাজ করবে না, তুমি মনঃসংযোগ করতে পারবে না। ফলে তখন- যা কিছু তুমি করবে, সবই তুমি খারাপ করবে। সেই সব বিশ্রী কাজ তোমার জীবনে বিশ্রী ফল নিয়ে আসবে। ফাঁকি দিয়ে, আধপোড়া ইঁট দিয়ে তুমি প্রাসাদ বানাবে; আর আশা করবে- তা হাজার বছর টিকে থাকুক; তা তো হয় না। আধপোড়া ইঁটের ঘর- এক বর্ষাতেই ধ্বসে যাবে।
অনেক সময় তুমি ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা পাবে। তখনও তোমাকে ধৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করতে হবে। আকাশে মেঘ করেছে, আর মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তুমি যদি মাথা কুড়ে কাঁদতে থাকো, তাহলে ঝড়-বৃষ্টি কি তাড়াতাড়ি বিদায় নেবে? না। ঝড় বৃষ্টি তার সময় অনুসারে আসবে, আর তার সময় অনুসারে বিদায় নেবে। তোমার যন্ত্রণাও তার সময় অনুযায়ী আসবে, আর তার সময় অনুযায়ী বিদায় নেবে।
তাহলে তোমার করণীয় কি? তোমার করণীয় হলো- সেই ঝড় বৃষ্টির দিনেও, তোমার নিজের কাজ (যা তোমার নিয়ন্ত্রণে) , ঠিক মতো করে যাওয়া। সেই ঝড় বৃষ্টির দিনেও জীবন উপভোগ করা। তুমি ভেবেছিলে- দিনটা হয়তো রোদ ঝলমলে হবে, আর তুমি তখন ঘুড়ি উড়িয়ে মজা করবে। কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেলো। তুমি কি তাহলে মাথা কুড়ে কাঁদবে? না। তুমি তখন ঘরে খিঁচুড়ি রান্না করে, পরিবারের সাথে মজা করবে। এজন্য তোমাকে শান্ত মাথায়, তোমার বুদ্ধি আর কল্পনাকে কাজে লাগাতে হবে। সব বিপদের মধ্যেই- এরকম ভালো কিছু লুকানো থাকে। সেজন্য তোমাকে নমনীয় হতে হবে, শান্ত আর কল্পনা প্রবন হতে হবে। জীবনে 'পারফেক্ট টাইম' বলে কিছু হয় না। যন্ত্রণার দিনেও তোমাকে হাত পা ছুঁড়ে নাচা শিখতে হবে।
তবেই তুমি জীবনকে উপভোগ করতে পারবে। নতুবা তুমি 'পারফেক্ট টাইম'-এর অপেক্ষা করতে থাকবে। আর দেখবে- সেই 'পারফেক্ট টাইম' আর কখনো এলো না। তারপর- অনুতাপ করতে করতে, একদিন তুমি মৃত্যুর বুকে ঢলে পড়লে। আমি লিখতে গিয়ে বুঝেছি- লেখার কোন 'পারফেক্ট টাইম' নেই। আমি এদেশে ফুল টাইম ডাক্তারি করি। ভীষণই ব্যস্ত জীবন। কিন্তু আমি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, ট্রেনে বা বাসে যেতে যেতে লিখি। আমি যদি 'পারফেক্ট টাইম'-এর অপেক্ষা করি; আমি নিশ্চিৎ- সেই 'পারফেক্ট টাইম' জীবনে কখনো আসবে না।
জীবনে, যন্ত্রণার বড় গুন হলো- জীবন তোমাকে এমন কিছু শেখায়- যা পৃথিবীর আর কেউ, কখনো তোমায় শেখাতে পারবে না। আর সেই শিক্ষা তুমি যদি না পাও, মানুষ হিসেবে তোমার শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যন্ত্রণা বড় প্রতিহিংসাপরায়ণ। যন্ত্রণাকে গালি দিলে, যন্ত্রণা তোমাকে আরও বেশী কষ্ট দেয়। যন্ত্রণাকে আদর করে বরণ করো, দেখবে- সে তোমাকে আর বেশী কষ্ট দেবে না।
© অরুণ মাজী
Painting: Iman Maleki
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem