(ঈশ্বর, মানুষ আর বিজ্ঞানকে নিয়ে এক গভীর কাটাছেঁড়া)
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
বিজ্ঞান- ঈশ্বর বিশ্বাসকে কুসংস্কার হিসেবেই দেখে। বিজ্ঞানের কাছে, মানুষের বুদ্ধিমত্তাই সব। যা কিছু বুদ্ধির অগম্য, বিজ্ঞান- সেগুলোকে ভালো চোখে দেখে না।
কিন্তু তোমরা কি জানো- বুদ্ধি দিয়ে, খুব বেশী হলে, তুমি একটা 'মাঝারি মাপের' কাজ করতে পারবে। কিন্তু 'তার চেয়ে অনেক বড়' কোন কাজ করতে হলে, তোমাকে বুদ্ধির বাইরে বেরোতে হবে। তোমাকে একরকম উন্মাদ হতে হবে। যে উন্মদনাকে, তুমি আর তোমার বুদ্ধি দিয়ে মাপতে বা সমর্থন করতে পারবে না। ঈশ্বরে বিশ্বাসও, তেমনি এক অতি শক্তিশালী উন্মাদনা। যা কিছু তুমি তোমার বুদ্ধি দিয়ে, অর্জন করতে পারবে না, সে সব কিছু- তুমি তোমার ঈশ্বর বিশ্বাস দিয়ে, অর্জন করতে পারবে।
আমি তখন কলকাতা মেডিকেল কলেজে, ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। আমার এক বন্ধুর বৌদি, পাঁচ বছর ধরে, প্রেগন্যান্ট হতে চেষ্টা করছিলো। কিন্তু সে বেচারার, সেই সৌভাগ্য ঘটে নি। আমি আর দাদা, বৌদিকে আমার এক প্রফেসরের কাছে নিয়ে গেলাম। প্রফেসর ওষুধ দিলেন, কিন্তু বৌদি, সেই ওষুধ খেয়ে আরও অসুস্থ হয়ে গেলো। এর আগেও বৌদি, হাফ ডজন ডাক্তার দেখিয়েছে। ফল কিন্তু প্রতিবারেই শূন্য। বৌদি মানসিক ভাবে, অবসাদগ্রস্ত আর উদ্বিগ্ন হয়ে গেলো।
অনেকদিন এই ভাবে ভুগার পর, বৌদি হটাৎ-ই ঠাকুর ভক্ত হয়ে গেলো। আমি মজা করে জিজ্ঞেস করলাম- 'কি ব্যাপার? হটাৎ- এই পরিবর্তন কেন? ' বৌদি বললো- 'আমি অনেক ভুগেছি। আর আমি, আমার দুর্ভাগ্য নিয়ে ভাববো না। আমি সব কিছু এখন, নারায়ণের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।'
এর মাত্র এক মাস পরে, দাদা আমাকে সুখবর দিলো- বৌদি প্রেগন্যান্ট। আমি খুব খুশি হলাম। যাক, বেচারার একটা হিল্লে হলো।
কি এমন ঘটলো, যে বৌদি হটাৎ প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলো? এ প্রশ্ন নিয়ে, আমি আর কোনদিন মাথা ঘামাই নি। বছর দশেক আগে, একদিন আমি শ্রীনিবাস রামানুজন নিয়ে পড়াশুনা করছিলাম। রামানুজন- কেমব্রিজ প্রফেসর 'হার্ডি'-কে বলেছিলেন, যে তিনি অংকের তত্ত্বগুলোকে ওনার চারপাশে ভাসতে দেখতেন। রামানুজনের বিশ্বাস ছিলো- এই সব স্বর্গীয় তত্ত্বগুলো, ঈশ্বর ওনাকে পাঠাচ্ছেন।
রামানুজন- অংকের কোন সমস্যার, 'স্টেপ' গুলো না করেই, তার উপপাদ্য বা সিদ্ধান্ত লিখে ফেলতেন। সে কারনে- কেমব্রিজের কোন প্রফেসর-ই ওনার তত্ত্বকে ঠিক বলে মনে করতেন না। সে কারনে, সমগ্র কেমব্রিজ- রামানুজনকে এক উন্মাদ বলেই ভাবতো। একমাত্র, প্রফেসর হার্ডিই তার ইনস্টিংক্ট দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন- যে রামানুজন যা বলছেন, তা সবই সত্য। কিন্তু তখনকার বিশ্বের, তাবড় তাবড় ম্যাথেমেটিশিয়ানের কাছে, রামানুজনের তত্ত্বকে গ্রহণ যোগ্য করতে হলে, সেইসব তত্ত্বগুলোকে স্টেপ বাই স্টেপ, প্রমান করার দরকার ছিলো। প্রফেসর হার্ডি- রামানুজনকে, সেটাই করতে সাহায্য করেছিলেন।
সেই সময়- রামানুজন যে তত্ত্ব পৃথিবীর মানুষকে দিয়েছিলেন, তা মানুষের বুদ্ধির অগম্য ছিলো। রামানুজন নিজে বলতেন- সেই তত্ত্বগুলো তিনি অঙ্ক করে বের করতেন না। উনি সেগুলো ঈশ্বরের কাছ থেকে, এমনি এমনি পেয়ে যেতেন। যেন- তত্ত্বগুলো ওনার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। উনি সেগুলো কেবল, একসাথে জড়ো করতেন।
হারিয়ে যাওয়া, বৌদির ঘটনাটা- হটাৎ-ই সেদিন মাথায় এলো। যেহেতু আমি ডাক্তার, তাই আমার মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকলো- ঈশ্বর বিশ্বাস কি, মানুষের অসুখের নিরাময় আনতে পারে?
বৌদি যেদিন মনে মনে সঙ্কল্প করলো- 'আমি অনেক ভুগেছি। আর আমি, আমার দুর্ভাগ্য নিয়ে ভাববো না। আমি সব কিছু এখন নারায়ণের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।' সেদিন থেকেই, বৌদির মনের- যত দুঃখ, বেদনা, উদ্বেগ, অবসাদ- সব ঘুচে গেলো। বৌদি তখন শান্ত আর সুখী হয়ে গেলো। বৌদি শান্ত হতেই, তার শরীরের 'হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারি-গোনাডাল এক্সিসের' সব হরমোন গুলো, আবার ঠিক ঠাক কাজ শুরু করে দিলো। হরমোন গুলো যখন ঠিক ঠাক কাজ শুরু করলো, তখনই সে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলো।
আমার মনে হয় না- ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ত্ব, কোন মানুষ- কোনদিন প্রমান করতে পারবে। কারন- যা কিছু পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরে, তাকে বুদ্ধি দিয়ে, মানুষ কখনো বাগে আনতে পারবে না। কাজেই সেই অনুর্বর প্রশ্ন করে, যন্ত্রণাকাতর সাধারণ মানুষের লাভ কি? এসব প্রশ্ন বড় বড় পন্ডিত আর দার্শনিকদের উপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
সাধারণ মানুষ বরং জিজ্ঞেস করবে- 'ঈশ্বরে বিশ্বাস কি, মানুষের কোন মঙ্গল করতে পারে? ' উত্তর- অবশ্যই হ্যাঁ। উদাহরণ- আমার 'সেই বৌদি', আর শ্রীনিবাস রামানুজন।
ঈশ্বরের জন্য যেমন মানুষ, মানুষের জন্য তেমনি ঈশ্বর। মানুষ যদি মরে যায়- কে ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখবে? বা কে তার জয়ধ্বনি গাইবে? ঈশ্বর যদি থাকেন, তবে তার এক উদ্দেশ্য আছে। কি সেই উদ্দেশ্য? মানুষের যন্ত্রণায়, মানুষকে একটু- সুখ দেওয়া, শান্তি দেওয়া। মানুষ প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য যন্ত্রণায় ভুগে। মানুষ জাতির কাছে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ- মহাকাশ বিজয় নয়, বা মানুষকে অমরত্ব প্রদান নয়। মানুষের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- তার প্রতি মুহূর্তের যন্ত্রণার নিরাময়।
যারা নাস্তিক, আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- ঈশ্বরকে যদি, ঈশ্বর হিসেবে গ্রহণ করতে না চাও, তাহলে তাকে এক মহৌষধি হিসেবে গ্রহণ করো। কেন? কারন - ঈশ্বরে বিশ্বাস, আমার বৌদির মতো কোটি কোটি মানুষকে, যন্ত্রণায় নিরাময় দিয়েছে। মানুষের জীবন আর যৌবন তো যন্ত্রণায় ঢাকা! তাই, কেউ যদি- ঈশ্বর বিশ্বাসে তার যন্ত্রণায় নিরাময় পায়, তাতে বিজ্ঞানী বা নাস্তিকদের এতো আপত্তি কেন?
বুদ্ধির অভ্যাস ভালো, কিন্তু বুদ্ধির অহঙ্কার ভালো নয়। আর বুদ্ধি যে কতখানি নির্বুদ্ধিতা, তা তো রামানুজনের কাহিনী পড়লেই বোঝা যায়।
আজ প্রায় পনেরো বছর হলো- আমি ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা আর গবেষণা করছি। শেষ পনেরো বছরে, আমি অন্তত দশ জন নোবেল বিজয়ীর সাথে একটু করে কথা বলেছি। আমি তাদেরকে একটাই প্রশ্ন করেছি- 'sir, what is your thought on God? ' তাদের প্রত্যেকের-ই উত্তরের সারমর্ম হলো- ' Yes, HE is great. HE takes me to a place, where my intelligence can't go' । শ্রদ্ধেয় আইনস্টাইনও, ঠিক এমনি ধরণের কথা বলতেন।
তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস করবে- 'তুমি আস্তিক অথবা নাস্তিক? ' আমার উত্তর- 'আমি জানি না, আমি সেই উত্তর এখনো খুঁজছি। তবে এটুকু বলতে পারি- যে এই খোঁজার পথটা কিন্তু, দারুন আলোময়। যতদিন না আমি আমার উত্তর পাচ্ছি- আস্তিক বা নাস্তিক, দুজনেই কিন্তু আমার পূজ্য। এ কেবল কথার কথা নয়। আমি আমার মেডিক্যাল প্র্যাকটিসে- ওয়েস্টার্ন মেডিসিন, আর ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা- দুই-ই একসঙ্গে প্র্যাক্টিস করি। আমি কখনো আস্তিক, কখনো নাস্তিক। যা দিয়ে, আমার বা আমার রুগীর যন্ত্রণার নিরাময় হয়, আমি তাকেই আঁকড়ে ধরি।
© অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem