গৃহ ধন পূর্ণ, অথচ অন্তর শান্তি শূন্য। বাইরে রঙের রোশনাই, অথচ অন্তরে আঁধারের আর্তনাদ। মানুষের এই সংঘাতময় জীবনযাত্রায়, কে পারে মানুষকে নিরাময়ের পথ দেখাতে?
বিজ্ঞান আমাদেরকে স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে, কিন্তু অন্তরে শান্তি দেয় নি। ধর্ম আমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু মোক্ষ বা অমৃত দেয় নি। সবাই যদি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদেরকে নরক যন্ত্রণায় নিক্ষেপ করে, তবে মানুষের মুক্তি কোন পথে?
তোমরা জানো- অরুণ মাজী তোমাদেরকে বারবার বলে, "যা কিছু প্রকৃতিতে ইতিমধ্যেই নেই, সে সব কিছু আমাদের জন্য নয়।" ব্যাপারটা কি রকম?
ঈশ্বর যেমন-
জন্মের সঙ্গে মৃত্যু দিয়েছেন
আলোর সঙ্গে আঁধার দিয়েছেন
সুখের সঙ্গে দুঃখ দিয়েছেন;
তেমনি তিনি
যন্ত্রণার সঙ্গে নিরাময় দিয়েছেন।
নিরাময় তবে কোথায়? নিরাময় সর্ব্বত্র। নিরাময় আকাশে, বাতাসে, নদীতে, মালবিকার নখের আঁচড়ে, তোমার অন্তরের অন্তঃস্থলে। আগে কি বলেছি আমি? ঈশ্বর যন্ত্রণা দিয়েছেন, তো নিরাময়ও দিয়েছেন। তাই নিরাময় এই সৃষ্টির সর্ব্বত্র বিরাজমান। তোমাকে তা খুঁজতে হবে।
কোন কিছু, কিভাবে খোঁজো তুমি? তুমি নিজেকে প্রশ্ন করো-
কি? কে? কোথায়? কেন? কবে? কি জন্য? ইত্যাদি প্রশ্ন করে। সেই প্রশ্নমালাকে একসাথে কি বলে? দর্শন (PHILOSOPHY) ।
তোমাকে, বিজ্ঞান অথবা ধর্ম- এরা কেউই একা একা নিরাময় দিতে পারে নি। বিজ্ঞান বড় বেশি পার্থিব বাস্তব হয়ে যায়, আর ধর্ম বড় বেশি অবাস্তব কল্পনা হয়ে যায়। তাই এই দুইকে একসাথে মিলিয়ে দিতে, দর্শনের আবির্ভাব। বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে যে অপূর্ণতা আছে, তাকে দর্শনের আলোতে মুছে ফেলা যায়।
তুমি ভাববে- আমি এক সাধারণ মানুষ, আমি দর্শন বুঝবো কি করে? তোমাকে কে বলেছে এই মিথ্যে? দর্শন সবার জন্য। অরুণ মাজীর মতো একটা গাধা যদি দর্শন বুঝতে পারে, তাহলে এই পৃথিবীর সবাই-ই দর্শন বুঝতে পারবে। দর্শন তো আমি, আমার মায়ের পেট থেকে শিখেছি। বিশ্বাস হয় না?
আমার মা এক্কেবারে মুখ্যু। অ আ ক খ-ও লিখতে পারতো না। কিন্তু আমার মা-ই আমাকে দর্শন শিখিয়েছে। কিভাবে?
আমি যখন ক্লাস ফোরে, তখন আমি স্কুলে, দৌড় প্রতিযোগিতাতে অংশ গ্রহণ করি। আমি চিরকালই একগুঁয়ে। যা কিছু করবো- হয় তা প্রাণ দিয়ে করবো, নয় তা করবো না। এই একগুঁয়েমিই আমার শক্তি।
প্রাণপণে দৌড়তে গিয়ে, মাঠে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে আমি আমার চোয়াল ছিঁড়ে ফেলি। দৌড় আমি জিততে পারি নি। আর জিততে পারি নি বলে, আমি সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরি নি। সন্ধ্যে হয়ে গেলেও আমি বাড়ি ফিরি নি। মা খুব চিন্তায়। খোঁজ খোঁজ রব। শেষে মা দেখে, আমি একটা বট গাছের নীচে শুয়ে। মায়ের কোলে উঠে কাঁদতে কাঁদতে আমি বলি-
"মা আমি হেরে গেছি।"
মা- "হেরেছিস তো বেশ করেছিস। তাতে কি? "
আমি রাগে তখন চীৎকার করে বলি-
"নাহঃ আমি হারতে চাই না। "
মা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে, আমার গালে চুমু দিয়ে বলে-
"জিততে গেলে হারতে হয়, খোকা।"
"জিততে গেলে হারতে হয়"। কালজয়ী এই দর্শন আমাকে কে শিখিয়েছে? আমার মা। অথচ মা আমার, প্রত্যন্ত গ্রামের নিরক্ষর এক গৃহবধূ। পরে আমি- হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মাইকেল স্যান্ডেল, ইয়েল ইউনিভর্সিটির শেলী কিগান- এদের থেকে দর্শন শিখেছি।
কোন ধর্মের সঙ্গে তুলনার মধ্যে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু আমাকে বলতেই হয়- দর্শন কেবল হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রেই এতো উজ্জ্বল। কেবল উজ্জ্বলই নয়- হিন্দু ধর্মটাই আসলে প্রচলিত অর্থে কোন ধর্ম নয়। হিন্দু ধর্ম আসলে এক দর্শন ক্ষেত্র । জীব, জীবন, মহাবিশ্ব আর সৃষ্টি- এরা কে কি? এদের মধ্যে কি সম্পর্ক? ইত্যাদির আলোচনাই হলো হিন্দু দর্শন। হিন্দু ধর্মকে যারা সংস্কারে বাঁধতে চায়, তারা হিন্দু ধর্মের "হ"-ও বোঝে না। তারা এক মূর্খ গোঁয়াড়!
কাজেই আমি যখন, আমার অহিন্দু পন্ডিত বন্ধুদের হিন্দু দর্শন পড়তে আর শিখতে বলি; ধর্ম তার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো- মানুষের জীবনের এক অতুলনীয় দর্শন আলোচনা।
আমি আবার বলছি- তোমরা হিন্দু হও, বা খ্রিস্টান হও, বা মুসলমান হও- তোমরা সবাই এই হিন্দু দর্শন পড়ো। যাদের "হিন্দু" শব্দে আপত্তি আছে, তারা হিন্দু শব্দটা না হয় ছিঁড়ে দিয়ে, বাকিটা পড়ো। কিন্তু জীবনের এই দর্শন তোমরা পাক্কা পড়ো।
© অরুণ মাজী
Painting: Raja Ravi Verma
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem