জীবনে এতো দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা নিষ্ঠুরতা! তবুও কিসের টানে বাঁচতে চাই আমরা? রাস্তার একটা ভিখারী- রোদ জল বৃষ্টি উপেক্ষা করে, কেন সে বাঁচতে চায়? ক্যান্সারে আক্রান্ত এক রোগী- শত যন্ত্রণা উপেক্ষা করে, কেন সে বাঁচতে চায়? একান্তে, এ প্রশ্ন নিজেকে কখনো করেছো? কি উত্তর পেয়েছো?
কেউ বলবে- পৃথিবীর মধ্যে এতো সৌন্দর্য্য, তাই আমি বাঁচতে চাই। কেউ বলবে- জীবনে, কাছের মানুষের এতো স্নেহ ভালোবাসা, তাই আমি বাঁচতে চাই। বাহঃ তোমরা দারুন বলেছো!
পৃথিবীর মধ্যে অসংখ্য নোংরামি আছে ঠিকই, কিন্তু অসংখ্য সৌন্দর্য্যও আছে। জীবনে ঘৃণা আছে ঠিকই, কিন্তু অনেক ভালোবাসাও আছে। তাই তো শত যন্ত্রণাকে তাচ্ছিল্য করে, আমরা বারবার বাঁচতে চাই।
কয়েকদিন আগে তোমাদেরকে বলেছিলাম- সৌন্দর্য্য প্রেমের জন্ম দেয়। আবার প্রেমও সৌন্দর্য্যের জন্ম দেয়। পৃথিবীর মধ্যে নয়নাভিরাম সমুদ্র পাহাড় বাগান আছে বলে, তুমি পৃথিবীকে ভালোবাসো। আবার তুমি তোমার প্রেয়সীকে ভালোবাসো বলে- তাকে তুমি, জগতের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দেখো।
সৌন্দর্য্য আগে, না প্রেম আগে? মুরগী আগে, না ডিম আগে? বৃষ্টি আগে, না নদী আগে? কে জানে! আমার মনে হয়- সৌন্দর্য্য আর প্রেম, একই রূপের রূপভেদ। জল কখনো নদী রূপে, কখনো বৃষ্টি রূপে। জীবন কখনো ডিমের রূপে, কখনো মুরগীর রূপে।
সৌন্দর্য্য যদি তোমার বাঁচার রসদ, তাকে বাড়ানোর জন্য, জীবনে তুমি কি করেছো? তুমি কি সুন্দরের সাধনা করো? সুন্দরের সাধনা তুমি কিভাবে করবে?
প্রতিমুহূর্তে তুমি যা কিছু করো, তা তুমি সবচেয়ে সুন্দর করে করার চেষ্টা করো। তুমি চিঠি লিখছো, তো তাহলে- হাতের লেখা সুন্দর করো, চিঠির ভাষা সুন্দর করো, চিঠির আবেগ সুন্দর করো।
তুমি গান গাইছো, তো প্রাণ ঢেলে তার তপস্যা করো। কণ্ঠে আবেগ আনো, গানের ভাবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাও। ইত্যাদি। তুমি তোমার বাড়ি আর বাড়ির বাগানকে, সুন্দর পরিপাটি করে রাখতে উদ্যোগী হও। অর্থাৎ- জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত তুমি সুন্দরের তপস্যায় নিয়োজিত করো।
খুব দুঃখের সঙ্গে বলছি- আমরা ভারতীয়রা কিন্তু সুন্দরের সাধনা করতে ভুলে গেছি। তার প্রমাণ চাও?
আগের যুগে, আমাদের 'নালান্দা' 'তক্ষশীলা' নামে বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো। সারা পৃথিবীর লোকজন সেখানে পড়তে আসতো। কেন? কারন- আমাদের পূর্বপুরুষরা তখন খুব আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তারা যা কিছু করতেন, পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার জন্য করতেন। সেজন্য তারা, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।
কিন্তু আজ? ভারতে সহস্র সহস্র বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু কোনটারই "মান" ভালো নয়। কেন? কারন- আমরা আত্মমর্যাদা হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী কেমন? "কিছু একটা যেমন তেমন করে করলেই হলো।"
"যা কিছু করবো, বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ করবো", এই মানসিকতা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এ জন্যই আমরা দেখি, প্রতিবছর- বলিউড, হলিউডের চেয়ে অনেক বেশি মুভি বানায়, কিন্তু তাদের কোনোটাই হলিউডের মতো, বিশ্ব মানের নয়।লোকে কেবল "নাম্বার" গুনছে। জিনিসটা যে পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়, তাতে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই।
আমার এক পরিচিত ব্যক্তি আমাকে বলেছিলো- "আমি স্কুল গড়বো, তুমি কিছু টাকা ইনভেস্ট করবে।" আমি বললাম- করতে পারি, তবে একটা শর্তে। সেই স্কুলকে (অন্তত)ভারতের শ্ৰেষ্ঠ নার্সারি স্কুল হতে হবে। ছোট করে শুরু করবো, তাতেও ভালো; কিন্তু সেই স্কুলে শ্রেষ্ঠ সুবিধা থাকতে হবে, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইত্যাদি নিয়োগ করতে হবে। ভদ্রলোক বললেন- "তাতে বিজনেস বাড়বে না।"
আমি তাকে বললাম- আমার নাম যা কিছুতে যুক্ত করবো, তাকে আমি শ্রেষ্ঠ দেখতে চাই। শ্রেষ্ঠ মানে সাইজে বড় নয়। ফোর্ড কোম্পানির নাম শুনলে যেমন ফোর্ড সম্পর্কে শ্রদ্ধা আসে, আমিও চাই- এই ছোট্ট নার্সারি স্কুলের নাম শুনলে, আমার সম্পর্কে মানুষের যেন সেই শ্রদ্ধা হয়। ভদ্রলোক আমার আর মুখদর্শন করেন নি।
আমি কখনোই ফোর্ডের মতো বড় হতে পারবো না। কিন্তু যে ক্ষুদ্র জিনিস আমি করবো- তার মধ্যে যেন আমার শ্রেষ্ঠত্বের একটা পিপাসা থাকে। আমি ভীষণই আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। কোন হীন কাজের সঙ্গে, আমি আমার নামকে কখনো জুড়তে পারবো না। আমি যদি অনাহারে মরেও যাই, তবুও ভালো। কিন্তু কোন হীন কাজে আমি নেই।
আজকাল বড় বড় ব্যবসায়ী আর রাজনীতিকদেরকে দেখো। তাদের দুবেলা খাওয়ার জন্য খাদ্য আছে, বাসস্থান আছে। তবুও তারা চুরি করছে। ডাকাতি করছে। মানুষ খুন করছে।
কেন করছে? কারন- কেউ তাদেরকে চোর বললো, বা ডাকাত বললো, বা খুনী বললো, বা ধর্ষক বললো- তাদের তাতে, কিচ্ছু যায় আসে না। কেন? কারন- তাদের আত্মমর্যাদা বা নিজেদের সম্পর্কে ন্যূনতম শ্রদ্ধাটুকুও নেই। এরা কৃমি বা কেঁচোর বিষ্ঠার চেয়েও, আরও বেশি ইতর। আমি অবাক হই, এদের স্ত্রীরা- এই রকম হীন নরকের কীট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ঘর করে কি করে! এদের নাম শুনলে, আমার গা বমি বমি করে।
এই হীন আত্মমর্যাদাহীন মানসিকতার জন্য, আমরা কোন কিছুতে আজ শ্রেষ্ঠ নই। আমি যখন মমতা ব্যানার্জীকে তুলোধুনা করে প্রবন্ধ লিখি, কিছু মস্তিস্কহীন মানুষ আমাকে গালি করে বলে- "মোদীও তো মিথ্যে বলছে। "তারা বলতে চায়- "মোদী যেহেতু পাপ করেছে, তাই মমতা ব্যানার্জীও পাপ করতে পারে।"
তুমি খুন করেছো কেন?
"কারন- যদুও খুন করেছে।"
যদু খুন করেছে বলে, তুমিও খুন করবে? এ আবার কোন নিয়ম?
দুর্ভাগ্য, এই মানসিকতা কেবল অশিক্ষিত মানুষদের মধ্যে নয়, আজকের শিক্ষিত এলিটদের মধ্যেও আছে। সব শালা কৃমি কেঁচো ব্যাঙাচির চেয়েও বেশি ইতর। শালাদের মুখগুলোকে, টয়লেটের প্যান হিসেবে ব্যবহার করতেও আমার লজ্জা হয়।
এই মানসিকতা নিয়ে- কি করে আমরা সুন্দরের সাধনা করবো? কি করে আমরা শ্রেষ্ঠত্বের সাধনা করবো?
হে ভাই, তোমরা আজ থেকে, তোমাদের মতো ছোট করে, সুন্দরের সাধনা করো। যা কিছু লিখবে, সুন্দর করে লিখো। যা কিছু বলবে, সুন্দর করে বলো। মালবিকার কাছে গেলে, সুন্দর করে সেজে যাও। মালবিকাকে "কিস" করলে, সুন্দর করে "কিস" করো। সৌন্দর্য্যকে তুমি, তোমার প্রতিদিনের অভ্যাস করে ফেলো। দেখবে, একদিন তুমি শ্রেষ্ঠ হবেই।
© অরুণ মাজী
Painting: Jean- François Portaels
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem