শ্মশানঘাটে জেগে উঠার কাহিনী মৃত্যুঞ্জয়ী তৃষ্ণা ১৩ অরুণ মাজীর উপন্যাস
-
বেশ চনমনে লাগছে তৃষ্ণাকে। সকাল থেকে আর জ্বর আসে নি তৃষ্ণার।
রীতাদি, তৃষ্ণার ব্লাড প্রেশার পাল্স রেট টেম্পারেচার মাপলো। ওর হাইড্রেশান পরীক্ষা করলো। পরীক্ষা শেষ হলে, চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে, রীতাদির দিকে চেয়ে রইলো তৃষ্ণা। রীতাদি হাসলো। বললো-
'They look good, Trishna.'
তৃষ্ণা বেশ খুশি হলো। রীতাদিকে, ওর বাবা-মার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো ও।
কাকু কাকীমা আগেও দেখেছেন রীতাদিকে। কিন্তু তখন ভালো করে আলাপ হয় নি। তৃষ্ণা আজ ভালো করে আলাপ করিয়ে দিলো।
কাকীমা, রীতাদির দিকে উৎসুক চোখে চেয়ে রইলেন। সেই চোখে কেমন যেন এক প্রশ্ন। হয়তো প্রশ্নটা করতে, ইতস্তত করছেন কাকীমা।
হয়তো রীতাদি তা অনুমান করলো। কাকীমাকে ও বললো-
'কালও যদি জ্বর না আসে, আর ব্লাড রিপোর্ট ঠিক থাকে; তো চিকিৎসার পরের স্টেজে যাবো আমরা।
কাকু সামনেই ছিলেন। উনি জিজ্ঞেস করলেন-
'পরের স্টেজ কি, রীতা? '
রীতাদি
ডাঃ কৃষ্ণান হয়তো, পরশু থেকে তৃষ্ণার কেমোথেরাপি শুরু করবেন।'
'কেমোথেরাপি' কথাটা শুনে চমকে উঠলেন কাকীমা। কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে গেলেন উনি। দিদিকে উনি জিজ্ঞেস করলেন-
'কেমোতে খুব কষ্ট হয়, তাই না? '
দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললো রীতাদি। তারপর তৃষ্ণার কাছে গিয়ে ওর কাঁধ ছুঁয়ে হাসলো। তৃষ্ণার ডান হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো-
'কষ্ট হয়। কিন্তু তৃষ্ণা খুব সাহসী। ও সব সামলে নেবে।'
দিদি এরপর তৃষ্ণার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো-
'তাই না তৃষ্ণা? '
তৃষ্ণা প্রশ্ন করলো-
'কি কি কষ্ট হয় দিদি? '
কিছুক্ষণ ভাবলো রীতাদি। তারপর বললো-
'বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে। তুই দুর্বল হয়ে পড়বি। সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়তে পারে। খাবারের স্বাদ হারিয়ে ফেলতে পারিস। মুখে ঘা হতে পারে। কনস্টিপেশান বা ডায়ারিয়া হতে পারে। তোর চুল পড়ে যেতে পারে।'
চমকে উঠলো তৃষ্ণা। আঁতকে উঠলো তৃষ্ণা। জিজ্ঞেস করলো-
'চুল পড়ে যাবে? '
রীতাদি
'কেমো চলাকালীন তা পড়তে পারে, কিন্তু পরে তা ঠিক হয়ে যাবে।'
রীতাদির উত্তর সান্ত্বনা দিতে পারলো না তৃষ্ণাকে। শূন্য চোখে, সিলিংয়ের দিকে চেয়ে রইলো ও। ধীর পায়ে, ওর দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। কিন্তু ও আমার দিকে চেয়েও দেখলো না।
তৃষ্ণার কাঁধ ছুঁয়ে, সাহস দেওয়ার ভঙ্গীতে রীতাদি বললো-
'শোন, সব কমপ্লিকেশান সবার হয় না। স্পিরিট উঁচু রাখতে হবে আমাদেরকে।'
ঘরের মধ্যে পায়চারি করলেন কাকু। বেশ নিঃশব্দে। হয়তো এভাবেই উনি, ওনার মধ্যেকার উদ্বেগকে প্রশমিত করার চেষ্টা করলেন।
এবার সবার উদ্দেশে রীতাদি বললো-
'শুনুন, এ সময় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সংক্রমণ। তাই আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। খালি হাতে তৃষ্ণাকে কেউ স্পর্শ করবেন না। খালি হাতে তৃষ্ণার বিছানা স্পর্শ করবেন না। যতদূর সম্ভব 'বডি কন্ট্যাক্ট' বা 'ক্লোজ কন্ট্যাক্ট' এড়িয়ে চলবেন।'
বেশ ঘাবড়ে গেলো তৃষ্ণা। চিন্তিত দেখালো কাকীমাকেও।
ওদেরকে চিন্তিত হতে দেখে, আমার বুকেও ভয় জেগে উঠলো। উঁচু স্পিরিট যেমন ছোঁয়াচে, ভয়ও তেমনি ছোঁয়াচে।
কাকু কেবল ভাবলেশহীন হয়ে চেয়ে রইলেন। রীতাদির কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন উনি।
কাকীমার হৃদয় যন্ত্রণা অনুভব করলো রীতাদি। কাকীমার দিকে এগিয়ে গেলো ও। কাকীমার চোখে চোখ রেখে, মৃদু স্বরে ও বললো-
'আপনি কিছু ভাববেন না কাকীমা। পৃথিবীতে, প্রতি বছর ১৯ মিলিয়ন লোকের নতুন ক্যান্সার ধরা পড়ে। তাদের বেশীরভাগকেই কেমো দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। বেশীর ভাগ মানুষ কিন্তু দিব্যি থাকে।'
মায়ের মন। তবুও মায়ের মন। মেডিক্যাল পরিসংখ্যান এক কথা। আর মায়ের মন অন্য কথা।
কোন মা-ই চায় না, কোন রকম কষ্ট তার সন্তানের বুকে আঁচড় কাটুক। সন্তানের সামান্য কষ্টেও, মায়ের বুক আঁতকে উঠে। তাই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো কাকীমার চোখে।
রীতাদির সান্ত্বনা সহানুভূতি, এসবের কোন কিছুই কাজে এলো না। পৃথিবীতে এমন কোন ছাতা নেই, যা মায়ের চোখের বৃষ্টিকে রুখে দিতে পারে। কাকীমার চোখের বৃষ্টি, আমাদেরকেও ভাসিয়ে দিলো।
এত মেঘলার মাঝে, এবার সূর্য হয়ে জেগে উঠলো তৃষ্ণা। ওর মায়ের দিকে চেয়ে ও বললো-
'তুমি মিছে চিন্তা করছো মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। '
তৃষ্ণার মুখে দীপ্তি। ফ্যাকাশে দুর্বল মুখ। তবুও তাতে সূর্যের দীপ্তি।
তৃষ্ণার চোখের দিকে চেয়ে, চোখের জল মুছলেন কাকীমা। দেখি, তৃষ্ণার চোখেও জল চকচক করছে। কিন্তু সে চোখের জল, ভেঙে পড়ার দুঃখ নয়। দৃঢ় এক প্রতিজ্ঞার। তৃষ্ণার চোখের সেই দৃষ্টি, সাহস দিলো কাকীমাকে। সাহস দিলো কাকুকে। সাহস দিলো আমাকে।
ভয় যেমন ছোঁয়াচে, জেগে উঠার লড়াইও তেমনি ছোঁয়াচে। মানুষের হৃদয়ের প্রতিজ্ঞাও তেমনি ছোঁয়াচে।
© অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem