পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে, সোজা বাথরুমে গেলাম। সেখানে চোখে মুখে জল দিয়ে, এক কোনে, সিঁড়ির উপর বসে পড়লাম। লম্বা শ্বাস নিয়ে, একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লাম- যাক বাঁচা গেছে। সব পরীক্ষা শেষ। মনে মনে আত্মসমীক্ষা করলাম- পরীক্ষা মোটেই খারাপ হয়নি। আমার চেষ্টার মধ্যে কোন ত্রুটি রাখিনি। তৃষ্ণার চিন্তা, আমার মনোযোগ যেমন একটু কেড়েছে, তেমনি আমাকে অনেক উৎসাহ-ও দিয়েছে। ভালো-টাই বরং পাল্লা ভারী।
প্রত্যাশার অনেক চাপ আছে। কিন্তু আমি ভাগ্যবান- যে আমার জীবনে, অনেক মানুষ আছেন, যারা আমাকে আগেই শিখিয়ে দিয়েছেন- কিভাবে সেই চাপ থেকে মুক্ত থাকতে হয়। ঈশ্বর করুণাময়। আমি মনে মনে, ঈশ্বরকে এ সব কিছুর জন্য, প্রণাম করলাম।
সকালে মাকে প্রণাম করে বলেছি-
মা, আমি কিন্তু পরীক্ষা শেষ হলেই কলকাতাতে যাবো।
মা হেসে বলেছে-
আগে পরীক্ষাটা তো ভালো করে দে। তারপর না হয়, ওসব ভাবিস।
তারপর বলেছে-
আমি মজা করলাম অমল। আমি জানি, তুই যা কিছু করিস, তা সর্বান্তঃকরণে করিস। চৈতি আর তৃষ্ণাকে বলিস, এখানে আসতে।
এই আমার মা। গতকাল রাতে, মা নিজেই আমার কলকাতা যাওয়ার জন্য, আমার ছোট ব্যাগ-টা গুছিয়ে দিয়েছে। আমি যে কোনদিন ভুল করতে পারি, মা তা কোনদিন মনেও আনে না। এতে আমি গর্বিত, কিন্তু মায়ের এই বিশ্বাস আমাকে আরও দায়িত্বশীল হতে শেখায়। মা-কে আঘাত করার চেয়ে, পৃথিবীতে- নিষ্ঠুর আর কিছু হতে পারে না।
মা-কে ভাবলেই
আমার-
আকাশ মনে পড়ে
সাগর মনে পড়ে
পর্বত মনে পড়ে।
আকাশ সমান ভালোবাসা
সাগর সমান গভীরতা
পর্বত সমান সহন।
স্রষ্টা মানুষকে বড় ভালোবাসেন-
তাই তিনি- আকাশ, সাগর আর পর্বত একত্র করে
মা রূপে মানুষকে দিয়েছেন।
না। দেরী হচ্ছে, এখন প্রায় সাড়ে চারটা বাজে। তৃষ্ণার বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে, রাত প্রায় আট-টা ন-টা বেজে যাবে। বাস স্টপ থেকে একটা বাস ধরে, ট্রেন স্টেশনে এলাম। স্টেশনে ততো বেশী ভিড় নেই। এখন হাওড়া থেকে, আসার ট্রেনে ভিড়, কিন্তু হাওড়া যাওয়ার ট্রেনে নয়। টিকিট কিনে স্টেশনে আসার সাথে সাথেই, ট্রেন পেয়ে গেলাম।
ফাঁকা কামরা। আমি ছাড়া আর জন কয়েক লোক হবে মাত্র। ট্রেনের জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে। সোয়েটার-টা পরে নিলাম। জানালাগুলো বন্ধ করতে ইচ্ছে করলো, কিন্তু দেখলাম সূর্যটা দিগন্তে, রাঙা হয়ে ডুবে যাচ্ছে। চলন্ত ট্রেন থেকে, রাঙা আলোতে, দূরের ধান জমি, বাড়িঘর, ক্ষেত-বাগান- সব-ই বড় সুন্দর লাগছে। শেষ কয়েক সপ্তাহ, প্রকৃতিকে ভালো করে দেখার সুযোগ হয় নি। পরীক্ষার একটা নিজস্ব জগৎ আছে, সে মানুষকে তার ভীতি দিয়ে, কেমন যেন আচ্ছন্ন করে রাখে। বড় নিষ্ঠুর এই পরীক্ষা ব্যাপারটা।
রাজা, দেবু, বাবলু, অনামিকা- এদের সাথে কথা হলো না। পরীক্ষার সিট ওদের অন্য কলেজে । প্রার্থনা করি- ওদের-ও যেন, পরীক্ষা ভালো হয়। আমি বাড়ি ফিরে এলে, ওদের সাথে একদিন খুব হৈ চৈ করবো । ঊ: কি মজা। শেষ, পরীক্ষার যন্ত্রনা শেষ। হটাৎ খেয়াল হলো- সন্ধ্যে হয়ে গেছে; ঠান্ডার তীব্রতা বাড়ছে। জানালাটা বন্ধ করে দিলাম।
চা চায় বাবু, চা। বাবু চা খাবেন নাকি?
চা-ওয়ালা ছেলেটি, আমার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে। বয়স আট কি দশ। মুখে হাসি, আর অদম্য উচ্ছ্বাসের ছাপ।
আমি হেসে বললাম-
দে ভাই, এক কাপ চা দে। আর বিস্কুটও দে।
একটু একটু খিদে পাচ্ছে, আর ক্লান্তিও একটু লাগছে।
চা ঢালতে ঢালতে ও বললো-
বাবু গরম গরম চা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম-
কে বানিয়েছে এই চা?
ছে- মা।
আ- তুই চা বানাতে পারিস না?
ছে- পারি। কিন্তু আমার মা-ই ভালো চা বানায়।
আ- তোর বাড়িতে আর কে কে আছেন?
ছে- আমার মা, দুটো ভাই আর একটা বোন।
আ- তোর বাবা?
ছে- আমার বাপ তো কবেই মরে গেছে। মদ খেয়ে খেয়ে, লিভার ফেল হয়ে মরে গেছে।
আ- তোদের চলে কি ভাবে?
ছে- মা বাবুদের বাড়িতে রান্নার কাজ করে। আর আমি চা বেচি।
আ- তুই স্কুলে কখনো যাস নি?
ছে- দু ক্লাস পড়েই ছেড়ে দিয়েছি। বাবু নাও, ফেরত টাকা-টা নাও।
আ- তুই ওটা রেখে দে। তোর স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না?
ছে- ইচ্ছে তো করে। কিন্তু স্কুলে গেলে, আমাদের সংসার চলবে না।
আ- দিনে কতো-টাকা রোজগার করিস তুই?
ছে- কোন দিন পঞ্চাশ টাকা, কোনদিন সত্তর টাকা।
আ- কতক্ষন কাজ করিস তুই?
ছে- সকাল আটটার সময় বেরোই। আর ঘরে ফিরি রাত ন-টার সময়।
আ- তোর মা চিন্তা করে না?
ছে- করে। কিন্তু মা-কে আমি বলি- 'আমি বড় হয়ে গেছি, মা। তোমার কোন চিন্তা নেই।
আ- আর তোর মা কি বলে?
ছে- মায়ের চোখটা জলে ভরে যায়। বলে- 'মা দুগ্গা, রাজুকে ভালো রেখো, মা। '
আ- তোর নাম রাজু?
ছে- হ্যাঁ।
আ- তুই বড় হলে কি হতে চাস, রাজু?
ছে- আমি নবগ্রাম স্টেশনে, বড় একটা চায়ের দোকান করতে চাই। বাবু, সামনের স্টেশন আসছে, আমি নেমে যাবো। আমাকে নবগ্রামে ফিরতে হবে।
আ- তুই ভালো থাকিস রাজু।
রাজু চায়ের কেটলি, আর ওর ভাঁড়ের ব্যাগ নিয়ে নেমে গেলো। ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করলো।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ভাবলাম- আমিও তো রাজু হয়ে জন্মাতে পারতাম। সকাল আটটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত, ট্রেনের কামরায়- 'চা চায় বাবু, চা চায়' বলে চীৎকার করতাম। কোন ভাগ্য বলে- কেউ অমল হয়ে জন্মায়, আর কেউ রাজু হয়ে জন্মায়?
আমরা মানুষ কেবল, আকাশে রামধনু দেখে, আকাশকে হিংসে করি; মাটির নীচে, দুর্বল কেঁচোর সংগ্রাম আর যন্ত্রনাময় জীবন দেখতে চাই না। আমরা ভাবি না- আমরা দুর্বল, অসহায় কেঁচো হয়েও তো জন্ম নিতে পারতাম। মানুষ- নীচে তাকানোর অভ্যাস যতদিন না করবে, মানুষ ততোদিন, তার নিজের তৈরী যন্ত্রণার আগুনে, ঝলসে ঝলসে মরবে।
ট্রেনটা বোধহয়- হাওড়ার কাছাকাছি এসেছে। কামরার মধ্যে লোকজন বাড়ছে। সকলের মুখে এক ক্লান্তির ছাপ। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, শেষে- ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরা। রাতটা শুধু নিজের বাড়িতে কাটানো, আর তারপরে আবার একটা দিন। এই কি জীবন? এই জীবনের জন্য- মানুষের এতো মায়া, এতো সংগ্রাম? হয়তো জীবনে আরও কিছু আছে। সেটা কি?
ট্রেনটা থেমে গেলো। হাওড়া এসে গেছি। হটাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলাম, যে- আমি এখন আমার তৃষ্ণার কাছে যাচ্ছি। সারাদিন পরীক্ষার ধকল, বাস আর ট্রেন ফিরে ফিরে, আমি এখন তৃষ্ণার কাছে যাচ্ছি। এতো ক্লান্তির মধ্যেও আমার মুখে এক চিলতে হাসি।
বুঝেছি- মানুষ সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শেষে, ক্লান্ত হয়ে কেন ঘরে ফিরতে চায়! ওদের প্রত্যেকের বাড়িতেই হয়তো- একটা করে তৃষ্ণা আছে, বা রাজুর মতো- একটা করে মমতাময়ী মা আছে।
© Arun Maji অরুণ মাজী
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem