আলো আঁধার ছায়া খন্ড ৬ Poem by Arun Maji

আলো আঁধার ছায়া খন্ড ৬

অমল প্রীতির গল্প অবলম্বনে অরুণ মাজীর উপন্যাস-
মাথার উপর আকাশ। অদূরে বিস্তৃত, তিলোত্তমা কলকাতা। আর চোখে আমার, স্বপ্নের ছায়া।

আমাদের বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে, কলকাতার অনেকটা দেখা যায়। আকাশের অনেকটা দেখা যায়। নিজের অনেকটা দেখা যায়। এই ছাদ আমার আশ্রম। এই ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে, নিজের সাথে অনেক কথা বলি আমি। আমার মতো যুবতী মেয়েদের, এই বয়সে যেসব নিয়ে সচরাচর ভাবার কথা নয়, সেসব ভাবি আমি। ভাবি- আকাশের বুক এতো শূন্য, তবুও আকাশ এতো মায়াবী কেন? এতো আকর্ষণীয় কেন?

শূন্যতারও কি সৌন্দর্য্য আছে? আকাশ শূন্য বলেই কি, আকাশের বুক চিরে আমাদের দৃষ্টি চলে যায়, দূরের কোন নক্ষত্রের দিকে? আকাশ যদি পূর্ণ হতো, তো এই নক্ষত্রগুলোকে আমরা দেখতে পেতাম না? শূন্যতারও কি অতি আবশ্যক এক অবদান আছে।

মানুষের জীবনেও কি শূন্যতা অতি আবশ্যক? শূন্যতা আছে বলেই কি, মানুষ তার জীবনে অনেক অনিবর্চনীয় সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারে? শূন্যতা কি জীবন আর মহাবিশ্ব দেখার আয়না?

হয়তো তাই। কৌতূহল হলো, অন্যরাও কি আমার মতো ভাবে? ডান দিকে, অমল মুখার্জীর দিকে চেয়ে দেখলাম আমি। দেখলাম- উনিও আমার মতো আকাশে নিমজ্জিত। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম-
আচ্ছা অমলবাবু, আপনি পূর্ণতা ভালোবাসেন? অথবা শূন্যতা?

উনি আমার কথার উত্তর না দিয়ে, আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসতে শুরু করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম-
হাসির কি আছে? প্রশ্নটা কি ছেলেমানুষী হয়ে গেলো?

"জানো প্রীতি, আমি ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছি।"

মানে?

"মানে হলো- আমার প্রলম্বিত যৌবন বেলায় অবশেষে ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছি আমি। "

বুঝলাম না। হেঁয়ালি না করে, একটুখুলে বলুন।

'প্রীতি, মানুষের সঙ্গে অন্য জীবদের তফাৎ এই যে- মানুষ উন্নত চিন্তা করতে পারে। আর অন্যান্য জীবরা ততটা চিন্তা করতে পারে না। মানুষ হিসেবে মানুষকে তখনই সুন্দর লাগে, যখন সেই মানুষ উন্নত চিন্তা করতে পারে। চিন্তা করার ক্ষমতা মানুষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গুণ। তুমি সুন্দর চিন্তা করতে পারো।"

এই একটা কথাতেই বুঝে গেলেন? অথবা আমি যুবতী মেয়ে বলে, সস্তা তারিফ করছেন?

"প্রীতি, আমিও চিন্তা করতে ভালোবাসি। তুমি আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে শূন্যতার সৌন্দর্য্যের কথা ভাবছো। আমিও এই ভাবনাটা প্রায়ই ভাবি। তাই তোমার প্রশ্নটা বেশ সহজেই বুঝতে পারলাম।"

আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনও পেলাম না।

"You are no one to demand my answer Ms. Acharya."

আমার কথা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন? মেয়েদের মতো, ঝগড়ুটে নাকি আপনি?

"নাহঃ। তোমার সাথে ঝগড়া করার মতো এতো আহাম্মক নই আমি। যে ফুলের রূপে মোহিত আমি, সেই ফুলের সাথে ঝগড়া যদি করবো; তো তার রূপ দেখে জীবন ধন্য করবো কখন? একটু মজা করলাম, এই যা।"

আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনও পেলাম না।

"শূন্যতা আর পূর্ণতা একে অপরের পরিপূরক। শূন্যতা নাহলে তুমি পূর্ণতা অনুভব করতে পারবে না। আর পূর্ণতা না হলে তুমি শূন্যতা অনুভব করতে পারবে না। কাজেই শূন্যতা আর পূর্ণতা, সমান সুন্দর।"

অমল মুখার্জী কথা বললে, ওনার ভেতর থেকে কেমন যেন এক আলো বের হয়। এই পুরুষটার কেবল, বুক আর বাহুর পেশীই শক্ত নয়, অনুভৱ আর বুদ্ধির পেশীও সমান শক্ত। মনে মনে ভাবলাম, আমিও কি তাহলে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে গেছি? দুষ্টুমি মাথায় এলো আমার। জিজ্ঞেস করলাম-
চিঠিটা এমন করে লিখলেন কেন?

"কেমন করে? "

একজন অল্প পরিচিত মেয়েকে সেন্সুয়াল এক চিঠি লিখতে বাধলো না আপনার?

"I am in love with you. Without passionate words, how could I express what I feel aboutyou? I wrote what I felt aboutyou."

আপনার লজ্জা হয় না?

"লজ্জা কিসের? তোমাকে যেদিন থেকে দেখেছি, সেদিন থেকে, কেবল তোমাকেই ভাবছি আমি।"

কেন? আমেরিকাতে আর কাউকে পছন্দ হলো না?

"পছন্দ হলে সুযোগ ঘটে নি। সুযোগ ঘটলে, পছন্দ হয় নি। পুরুষ হয়ে, নারী সাহচর্যের জন্য ছোঁক ছোঁক করি নি, সেই মিথ্যে বলি কি করে? "

কেন? আমাকে খুশি করতে।

"নাহঃ আমি পারি না।"

আপনি রোমান্টিক নন তাহলে।

"উঁহু, বরং উল্টোটা।"

মানে?

"রোমান্সের জন্য অনুভবের দরকার। মিথ্যের আবরণ নয়।"

মায়ের বাগানটা দেখবেন না?

"তুমি তো দেখালেই না।একটা অনুরোধ করবো, প্রীতি? "

কি?

"আমাকে তুমি, অমল নামে ডেকো।"

আমি কিন্তু আপনার প্রেমে পড়ি নি।

"তুমি কিন্তু আমাকে, ইতিমধ্যেই ছুঁয়ে দিয়েছো।"

মানে?

তুমি আকাশ দেখতে দেখতে, আমার হাতে হাত রেখেছো। এখনো কিন্তু তুমি আমাকে ছুঁয়ে রয়েছো।

কই, না তো
হটাৎ আঁতকে উঠলাম আমি। ইশঃ নিজের অজান্তেই ওনার হাতে হাত রেখেছি আমি? আমি তা টেরও পাই নি! লজ্জায় দাঁত দিয়ে ঠোঁট কাটলাম আমি। অমল মুখার্জী আমার দিকে চেয়ে হাসলেন। বললেন-
"মানুষের কথা ছলনা করে। হৃদয় করে না।"

মানে?

"তোমার সচেতন মন আমাকে এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু তোমার সুপ্ত অবচেতন (subconscious)আমাকে ছুঁতে চায়।"

আমার মুখের দিয়ে তাকিয়ে, অমল মুখার্জী কিছুক্ষণ অপলকে চেয়ে রইলেন। পরে বললেন-
"এতে লজ্জার কি আছে? এতো আকাশের দোষ। প্রকৃতিরসৌন্দর্য্য এতটা শক্তিশালী, সে মানুষের গর্ব কেড়ে নিয়ে তাকে সরল সুন্দর শিশু বানিয়ে দেয়।কৃত্রিম বুদ্ধির আবরণ খুলে, হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দেয়। প্রকৃতির ক্ষমতার কাছে, মানুষের কোন ঘোমটা টিকে না।

ধরা পড়ে গেছি আমি। হ্যাঁ নিজের কাছে নিজে ধরা পড়ে গেছি আমি। অমল মুখার্জীর প্রেমে ডুবেছি আমি।উনি আমার দিকে চেয়ে। আমিও ওনার দিকে চেয়ে।

মানুষটা উচ্ছ্বাসী কিন্তু প্রশান্তও বটে। ওনার দৈহিক আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য, কিন্তু বুদ্ধির আকর্ষণ আরও বেশী। টি শার্টের আবরণ ভেদ করে, বুকের পেশী বেরিয়ে
আসতে চাইছে। কিন্তু দেহের আবরণ ভেদ করে অন্তরের সৌন্দর্য্য ঠিকরে পরতে চাইছে।

আমার শূন্য অন্তর হটাৎ পূর্ণ মনে হলো। হয়তো সত্যি সত্যিই, মানুষটা ভালোবাসার যোগ্য। হয়তো মানুষটার পেশী বহুল বুকে, আঁচড় কাটতে কাটতে, তাকে অনেক গোপন কথাই বলতে পারি আমি।

মায়াবী চোখে, গভীর এক তৃষ্ণা নিয়ে উনি তখনও আমার দিকে চেয়ে। আমি বললাম-
এসো অমল, বাগনাটা ঘুড়ে আসি।

অমল তার হাতটা ধরার জন্য, আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।

ওর হাত ধরলাম আমি। সাঁতার কাটতে কাটতে, ক্লান্ত মানুষ যেমন কোন অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে; অমলের হাতটা, তেমনি শক্ত করে ধরলাম আমি। মিথ্যে প্রথা আর বিশ্বাসের স্রোতে, সাঁতার কাটতে কাটতে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম আমি।

© অরুণ মাজী

আলো আঁধার ছায়া খন্ড ৬
Wednesday, July 1, 2020
Topic(s) of this poem: romance
COMMENTS OF THE POEM
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Close
Error Success