কাগজে খবর- পনেরো বছরের তিন্নি, প্রেম করার কারনে মায়ের বকা খেয়ে আত্মহত্যা করেছে!
পৃথিবীর যে কোন সমস্যাকে তুমি যদি গভীর ভাবে খুঁড়ো, দেখতে পাবে- তার কারন- কেবল 'প্রেমের অভাব'। আর পৃথিবীর যে কোন আনন্দকেও তুমি যদি গভীর ভাবে খুঁড়ো, দেখতে পাবে- তার কারন- কেবল 'প্রেমের প্রাচুর্য্য'।
যেখানেই প্রেমের অভাব, সেখানেই যন্ত্রণা। যেখানেই প্রেমের প্রাচুর্য্য, সেখানেই আনন্দ। আজকের পৃথিবীর এই হানাহানি, খুনোখুনি এই প্রমান করে যে- আজকের মানুষ, ভালোবাসতে ক্রমশ ভুলে যাচ্ছে।
অপেক্ষাকৃত প্রেমহীন এই পৃথিবীতে, তাই যখন কোন প্রেমিক-কে আত্মহত্যা করতে হয়, তা কেবল সেই পরিবারের পরাজয় নয়; তা সমস্ত মানুষ জাতির পরাজয়। কাজেই, আমি যখন ছোট ছোট বয়সের প্রেমিক প্রেমিকাকে আত্মহত্যা করতে শুনি, আমার চোখে তখন জল চলে আসে। হায় ঈশ্বর! তুমি পৃথিবীর ভালো ভালো স্বপ্ন আর প্রতিশ্রুতিগুলোকেই কেড়ে নিচ্ছো!
তুমি যখন নিজের স্বার্থকে আগে দেখো, তখন তুমি সাবধানী হও। কাজেই সাবধানী মন নিয়ে, তুমি পারস্পরিক স্বার্থের একটা সম্পর্ক তৈরী করতে পারো, কিন্তু তাকে সত্যিকারের নিঃস্বার্থ প্রেম বলে না। তোমরা জানো- আমি মাঝে মাঝে বিদ্রূপের সুরে বলি, সাবধানী ভদ্দরলোক কখনো- প্রেমিকও হয় না, আর বিপ্লবীও হয় না। প্রেম আর বিপ্লবের জন্য- আকাশের মতো বড় হৃদয় দরকার, আর সিংহের মতো বুকে সাহস দরকার। সাবধানী ভদ্দরলোক- সাহসে ইঁদুরবাচ্চা, আর হৃদয়ে চামচিকে। কাজেই প্রেম বা বিপ্লব, তাদের কাজ নয়। তবুও তারা কিন্তু, লোক দেখানো আস্ফালন করতে ভুলে না।
যা বলছিলাম- এই পৃথিবীকে সুন্দর করতে, আমরা সবাই দায়বদ্ধ। সেজন্য আমাদেরকে যেকোন আত্মহত্যা রুখতে হবে। আত্মহত্যা 'পাপ' বলে দিলেই আত্মহত্যা বন্ধ হয়ে যায় না। 'অশ্লীল' কথাটার মতো, 'পাপ' কথাটাও রাজনৈতিক। মানুষ কখনো তার ব্যর্থতা ঢাকতে, কখনো তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে শূলে চড়াতে, কখনো তার কায়েমী স্বার্থ উসুল করতে- 'অশ্লীল' 'পাপ' এইসব শব্দগুলো ব্যবহার করে। তুমি কি পারবে অশ্লীল তকমা দিয়ে মানুষের হৃদয়ের কদর্যতাকে ঢাকতে? যে মানুষ দিনের বেলায় একজন নারীকে 'অশ্লীল, বারাঙ্গনা' বলে গালি দেয়, সেই মানুষই- সেই নারীকে, রাতের বেলায় বিছানায় পাওয়ার জন্য, কাটা ছাগলের মতো ছটফট করে। তবুও মানুষ কাউকে পাপী বা অশ্লীল বা বারাঙ্গনা বলতে ছাড়ে কি? ছাড়ে না। কেন? কারন এই সব শব্দ-অস্ত্রগুলো, প্রতিদ্বন্দ্বীর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়ে, মানুষ তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে সহজেই ঘায়েল করতে পারে।
এই কারনেই এই সব শব্দগুলো- ধর্মগুরুরা বেশী ব্যবহার করে। তারা এই সব শব্দ দিয়ে, গরীব, শিশু, নারী- ইত্যাদি দুর্বল মানুষকে দাবিয়ে রাখে। বাবা-মায়েরা যেহেতু কিশোর কিশোরীদের থেকে, শারীরিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে বেশী শক্তিশালী, তাই তারা তাদের মতামত আর বিচার- ছোটছোট ছেলেমেয়েদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়। তারা ভালোবাসে কম, শাসন করে বেশী। তারা তাদের সন্তানকে বোঝে কম, কিন্তু বিচার করে বেশী। তারা তাদের সন্তানদেরকে উড়তে যত না সাহায্য করে, তার থেকে তাদেরকে খাঁচায় ভরতে বেশী ভালোবাসে।
ভালোবাসা একটা শক্তির নাম, যে শক্তি মানুষকে স্বাধীন আর শক্তিশালী করে। যে ভালোবাসা মানুষকে স্বাধীন করে না, শক্তিশালী করে না, মুক্ত আকাশের বিহঙ্গ করে না, সে ভালোবাসা- ভালোবাসা নয়। তা ভালোবাসার নামে- স্বার্থের সম্পর্ক তৈরী করা।
বাবা-মায়ের এই বিচার প্রবণতা, সমালোচনা, আর গুরুগিরির জন্য- ছেলেমেয়ে তাদের নিজস্ব গোপন ব্যাপার তাদের বাবা-মাকে খুলে বলতে পারে না। কোন এক বাচ্চা হয়তো মরমে দগ্ধে দগ্ধে মরছে, তবুও সে তার যন্ত্রণার কথা- তার বাবা-মাকে বলতে পারে না। এই প্রকার নিঃসঙ্গতা, অসহায়তা, ভালোবাসাহীনতাতে ভুগতে ভুগতে, সে একদিন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
আর প্রেমের কথা বলছো? তোমাদেরকে কতবার বলবো- যে মানুষ প্রেম করে না. প্রেম এমনি এমনিই ঘটে যায়? কাজেই যতই তুমি সাবধান হও, সেই পিচ্ছিল সন্ধিক্ষণ যেদিন আসবে- সেদিন তুমি এমনি এমনিই হড়কে যাবে। প্রেম এক মহাসুনামি- তাকে প্রতিরোধ করা, মানুষের কম্ম নয়। তোমরা জানো, কয়েকদিন আগে আমি লিখেছিলাম-
প্রেমে কেউ পড়ে না সখী
প্রেম হয়ে যায়।
রাধার পিচ্ছিল চোখে কানু
হড়কে হড়কে যায়।
আজ আবার বলি-
প্রেমে কেউ পড়ে না সখী
প্রেম হয়ে যায়।
বাগানে ফুল তুলে রাধা
কানুর বাঁশি খুঁজে বেড়ায়।
মানুষকে দিনরাত যদি বিচারই করবে, তবে তাকে ভালোবাসবে কখন? একটু না হয়, কম সমালোচনা করলে! একটু না হয়, গুজব না ছড়িয়ে মানুষকে কম আঘাত করলে! ভাবো তো- তোমার সমালোচনা বা গুজবের একটু আনন্দ, অন্য মানুষের কি ভাবে মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়ায়!
ধৈর্য্য ধরতে শিখো হে মানুষ, একটু ধৈর্য্য ধরতে শিখো। তোমার কোন কিছু পছন্দ হয় নি বলেই কি, তুমি কাউকে তোমার সমালোচনা বা গুজব দিয়ে আঘাত করতে পারো? তুমি যদি একটু বেশী আর একটু নিঃস্বার্থ ভালোবাসো, তাতে কি তোমার ক্ষতি কিছু হয়? সমালোচনা বা গুজব দিয়ে কখনো ভালো কিছু অর্জন করতে পেরেছো?
বাবা মা তিরস্কার করে, বন্ধুরা গুজব ছড়ায়, আত্মীয় পরিজন নিন্দা করে- ছোট্ট ছোট্ট কিশোর কিশোরীদেরকে তবে কে ভালোবাসবে? কে তাদের আঁধার দিনে, তাদের বুকে হাত বুলিয়ে বলবে- 'ভয় নেই রে অমল, ভয় নেই। আমরা সবাই তোর সাথে আছি।' কিন্তু কেউ এই হতভাগ্যদেরকে বোঝে না। হায় ঈশ্বর! কি সাংঘাতিক নির্মম এই পৃথিবী!
কিশোর কিশোরীরা অপরিপক্ক, আবেগপ্রবণ তো হবেই! যে নদী সবে মাত্র পাহাড়ের উঁচু ঢালে জন্ম নিলো, তার উচ্ছ্বাস তো বেশী হবেই। যে কিশোর এই মাত্র পুরুষ হলো, তার একটু দুঃসাহস তো হবেই! যে কিশোরী এই মাত্র এক নারী হলো, তার স্বপ্ন একটু অদম্য তো হবেই।
যারা অপরিণত, অবিবেচক- তাদেরকে সমালোচনা বা পরিত্যাগ করলে; তারা পরিণত বা বিবেচক হয় না। তাদেরকে ভালোবেসে বোঝাতে হবে; সুখ দুঃখের সাথী হয়ে তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। তাদেরকে তাদের বিপদের দিনে সাহায্য করতে হবে। এই ভাবেই যারা অপরিণত বা অবিবেচক; তাদেরকে পরিণত আর বিবেচক করতে হবে।
দেখতে শিখো হে মানুষ, দেখতে শিখো! চোখ দিয়ে নয়! হৃদয় দিয়ে। চোখ তোমাকে কেবল উপরটা দেখায়। ভেতর দেখতে হলে তোমার অনুভূতিকে জাগ্রত করো। কিভাবে তোমার অনুভূতিকে জাগ্রত করবে? ভালোবাসো। অনেক বেশী বেশী ভালোবাসো।
© অরুণ মাজী
Painting: William-Adolphe Bouguereau
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem