বুকে তীব্র দহন নিয়ে, জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে সূর্য আমাদেরকে আলো দিচ্ছে। অথচ তিন্নির মা সপ্তাহে তিনদিন ভাপা ইলিশ রান্না করে। সূর্যের ব্যথায় কাতর হয়ে, তিন্নির মা তাকে ডেকে কখনো বলে নি- "আহাঃ বেচারা সূর্য রে! খেটে খেটে তুই রোগা হয়ে যাচ্ছিস। আয়, আমার বাড়িতে আজ ভাপা ইলিশ খেয়ে যা।"
সূর্যের পিঠ কেউ কখনো চাপড়ে দেয় না। তবুও সে পুড়ে ছাই হতে হতে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমার মতো ব্যাঙাচি মার্কা ছাপোষা মানুষ যারা, তাদেরকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য পিঠ চাপড়ে দিতে হয়। যারা বড় তারা এমনিতেই বড়। তারা একা একাই জ্বলতে পারে। কিন্তু ক্ষুদ্র হৃদয়ের ছাপোষা মানুষ যারা, তারা তা পারে না। আমাদের পৃথিবীর সাতশো কোটি মানুষের বেশির ভাগই ক্ষুদ্র হৃদয়ের ছাপোষা মানুষ। আমাদের প্রত্যেককেই তাই, পরস্পরের পিঠ চাপড়ে দিতে হয়।
আমরা ক্ষুদ্র, কিন্তু আমাদের জীবন যন্ত্রণা ক্ষুদ্র নয়। কখনো কখনো তা এতো বড় যে, সুন্দর এই ধরিত্রী ছেড়ে আমরা আত্মহত্যা করতেও পিছু হটি না।
মানুষ হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই ভীষণ ক্ষুদ্র। প্রত্যেকেই ভীষণ দাহ্য আর যন্ত্রণাকাতর। তবুও আমরা সকলেই কিন্তু মাঝে মাঝে খুবই সাহসী হয়ে উঠি। আমরা চোখের জল উপেক্ষা করে হাসি। ছেঁড়া হৃৎপিন্ডের আর্তনাদ বুকে নিয়ে ভালোবাসি। তাই বা কম কিসের? মানুষ বলে কি, ফ্যালনা নাকি আমরা?
দেবতার মতো আমাদের সৌভাগ্য নয়। স্বর্গে বসে, ঊর্বশীর অর্দ্ধনগ্ন নৃত্য দেখতে দেখতে সুরা পান- মানুষের কপালে জোটে না। তারপরও দেবতার ভাগ্যে কত স্তুতি আর সন্ধ্যারতি জোটে! কিন্তু মানুষের ভাগ্যে? এক মানুষ অন্য মানুষের পশ্চাৎদেশে কাঠি নাড়ে। মানুষ মানুষকে যন্ত্রণা দেয়, বিষ খাইয়ে মারে। মানুষের যন্ত্রণায় কোন দেবতাকে ছুটে আসতে আমি দেখি নি। এক মানুষই অন্য এক মানুষের বিপদে সাহায্য করতে ছুটে আসে। মানুষের জন্য সামান্য এই শ্রদ্ধা আমাদের নেই কেন? মানুষ হয়ে আমরা মানুষকে শ্রদ্ধা করতে পারি না কেন?
দেবতাকে শ্রদ্ধা আমরা নিশ্চয়ই করবো। তাই বলে, মানুষকে আমরা ঘৃণা করবো? কষ্ট দেবো? অহেতুক সমালোচনার আগুনে তাকে দগ্ধ করবো? পাথরের দেবতার এতো স্তুতি করতে পারো, মানুষকে একটু উৎসাহ দিতে পারো না? কোন মানুষ ছোট খাটো কিছু কাজ করলে, তাকে অহেতুক সমালোচনার আগুনে পুড়িয়ে মারো কেন? কাউকে যদি উৎসাহ দিতে নাও পারো, তাকে অহেতুক নিরুৎসাহ করো কেন?
ঠোঁট আছে বলেই তা নাড়তে হবে? কথা তখনই বলো- যখন তোমার কথা
১. অন্যকে উৎসাহিত করতে পারে।
২. অন্যের মুখে হাসি আনতে পারে।
নতুবা কথা দিয়ে অন্যের বুকে ব্যথা আনো কেন? মানুষের কল্যাণ করতে চাও? পৃথিবীর কল্যাণ করে মহান মানুষ হতে চাও? তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। কেবল- সাধারণ মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে যে সব ছোট ছোট কাজ করছে, তাকে তা করতে উৎসাহ দাও। এই সামান্য কাজ কি এতটাই শক্ত? মহান হওয়া কি এতটাই কঠিন?
তোমার উৎসাহ প্রদান যদি, একজন মানুষের জীবন একটুখানি বদলে দিতে পারে, তা করতে তোমার বুক ফাটে কেন? আজ তুমি আমার পিঠ চাপড়ে দেবে। কাল আমি তোমার পিঠ চাপড়ে দেবো। এই ভাবেই আমরা পরস্পরকে উৎসাহিত করতে থাকবো। জীবনে তোমারও অসহ্য যন্ত্রণা, জীবনে আমারও অসহ্য যন্ত্রণা। কারও যন্ত্রণা কম বা বেশি নয়। এই যন্ত্রণাকাতর জীবনে আমরা পরস্পরকে এমনি ভাবে যদি সাহায্য করি, তাহলে আমাদের উভয়েরই যন্ত্রণার উপশম হবে।
কোন অভিনেতার কেচ্ছা দেখলে আমরা তার উপর মন্তব্য আর প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিই। কিন্তু তোমার প্রতিবেশী রাত জেগে খেটে খেটে পরীক্ষায় পাশ করেছে, সেই খবর শুনলে তোমার বুকে তীব্র দহন হয় কেন? তোমার খারাপ সময়ে, তোমার প্রতিবেশীই তো তোমাকে সাহায্য করতে আসবে। তোমার আত্মীয়ই তো তোমাকে সাহায্য করতে আসবে। অভিনেতার কেচ্ছা শুনে তোমার লাভ কি? অভিনেতার জন্য এতো দরাজহস্ত তুমি, কিন্তু তোমার প্রতিবেশী আর আত্মীয়ের জন্য এতো হিংসা আর বিদ্বেষ কেন? তোমার প্রতিবেশী বা আত্মীয় হওয়াই কি পাপ তাদের?
মানুষ নাকি বুদ্ধিদীপ্ত জাতি? এই তার বুদ্ধির নমুনা? যে প্রতিবেশী আর আত্মীয় তোমাকে বিপদের দিনে দেখবে, তার জন্য তোমার কোন যত্ন নেই, কিন্তু কেচ্ছা মার্কা চরিত্রহীন অভিনেতার জন্য তুমি এতো দাতা কর্ণ! তা কেন?
ঈশ্বরকে যদি এতো ভালোবাসো আর শ্রদ্ধা করো, তাহলে ঈশ্বর প্রদত্ত মস্তিষ্কের ব্যবহার না করে, ঈশ্বরকে এতো তাচ্ছিল্য করো কেন? শুধু গোমূত্র খেলেই তুমি ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র হয়ে যাবে? ঈশ্বর কি আমার মতো নীচ আর ঘৃণ্য নাকি?
পৃথিবী বদলে দিতে চাও? জীবনে মহান হতে চাও? তাহলে মস্তিষ্ক আর হৃৎপিণ্ডের ব্যবহার করতে শেখো। মানুষের হৃৎপিণ্ড আর মস্তিস্ক ঈশ্বরের এমন এক অবদান, বিজ্ঞান যুগযুগ ধরে যত লম্ফ ঝম্ফ করুক না কেন; অবিকল এই রকম মস্তিস্ক আর হৃৎপিণ্ড বিজ্ঞান কখনো গড়তে পারবে না। ঈশ্বরের এই সৃষ্টিকে শ্রদ্ধা করতে শিখো। মানুষ হয়ে আরেক মানুষকে ভালোবাসতে শিখো, শ্রদ্ধা করতে শিখো, তাকে উৎসাহ প্রদান করতে শিখো।
দিনরাত রাম রাম আর আল্লাহ আল্লাহ বলে চীৎকার করলেই ঈশ্বর পূজা কখনো হয় না। যত্তসব ফাজিল ছুঁচো কোথাকার!
© অরুণ মাজী
Painting: William-Adolphe Bouguereau
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem