উত্তরণ খন্ড ২৯খ (Trishna)
কার্গিল যুদ্ধ অবলম্বনে অরুণ মাজীর উপন্যাস উত্তরণ খন্ড ২৯খ
এপ্রিল মাসের খাঁ খাঁ রোদ। লক্ষ্নৌ যে এমন তীব্র উত্তপ্ত হতে পারে, এ ধারণা আগে আমার ছিলো না। একটানা দু ঘন্টা ড্রিল করার পর, প্রায় চার ঘন্টা ধরে লেকচার শুনেছি। লেকচার শুনতে শুনতে, বারবার ঘুম পেয়েছে আমার।
নাহঃ আমার একার নয়। প্রায় সবারই। সেজন্য প্রায় প্রত্যেকেই আমরা, ইন্সট্রাক্টারের তিরস্কার শুনলাম। এই ভয়ঙ্কর গরমে ড্রিল ট্রেনিং করার পর, আমরা সবাই ডিহাইড্রেটেড। সঙ্গে, ভীষণই ক্লান্ত। ডাক্তাররা আর কি কখনো স্পোর্টসম্যানদের মতো ফিট হতে পারে?
বেলা এগারোটার সময়ই, লক্ষ্নৌয়ের তারপমাত্রা, ৪০ ডিগ্রীর উপর পৌঁছে যায়। একে গরম। তারপর শুখনো হাওয়া। এই ভয়ানক তাপমাত্রার মধ্যে, কংক্রীটের উপর টানা দুঘন্টা ড্রিল প্রাক্টিস । তা শুধু কষ্টকরই নয়, বড় যন্ত্রণাদায়কও বটে।
গোদের উপর বিষফোঁড়া এই যে, আগামীকাল থেকে, ড্রিল ক্লাস দুঘন্টা নয়। তিনঘন্টা ধরে চলবে। আজকেরই ড্রিল গ্রাউন্ডের ঘটনা, আমারই এক সহপাঠী, ড্রিল চলাকালীন অজ্ঞান হয়ে পড়লো।
মিলিটারি হিস্ট্রি, মিলিটারি ল, মিলিটারি ট্যাক্টিক্স- এ সবই ভীষণ শুখনো বিষয়। এ সব বিষয়, পৃথিবীর কোন ডাক্তারকেই কখনো আকর্ষণ করবে না। কাজেই ঘুম আসা, কিছুই অস্বাভাবিক নয়।
এ সব ভাবতে ভাবতে, বুক ভারী হয়ে উঠলো আমার। চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। নিজেকে কেমন যেন দুর্বল অসহায় মনে হলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো- আমার সতীর্থের জ্ঞানশূন্য হয়ে যাওয়া চোখ। আর তার ফ্যাকাশে মুখ। শক্ত সমর্থ পাগড়ি বাঁধা পাঞ্জাবী ছেলে। সেও কিনা এই উত্তাপ সহ্য করতে পারলো না? কে জানে, বেচারা হয়তো বেশী করে জল খায় নি! তাই ডিহাইড্রেশন হয়ে এই বিপত্তি।
চলমান এই অত্যাচারের কথা স্মরণ করে ভাবলাম, আমি কি তাহলে হাল ছেড়ে পালিয়ে যাবো? পালানোর কথা ভাবতেই, বিষ্ণু বাবুর কথাগুলো মনে পড়লো আমার। মাস্টারমশাই বলেছিলেন-
'অমল, যেদিন তুই খুব যন্ত্রণা পাবি; এমন যন্ত্রণা যে, তুই হাল ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে চাইবি, সেদিন তুই তোর মায়ের- জল ভরা চোখ দুটোকে স্মরণ করবি। দেখবি, পৃথিবীর কোন যন্ত্রণাকে আর যন্ত্রণা মনে হবে না। পৃথিবীর সব যন্ত্রণাকে তোর, জল ভাত মনে হবে।'
চোখ মুছে, মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করলাম আমি। হ্যাঁ, মায়ের জল ভরা দুটো চোখ।
মা, আমার মা। পঁচিশ বছর বয়স থেকে, সাদা শাড়ি পড়া, আমার বিধবা মা। সংসারী হয়েও, ঋষিসম ত্যাগী আমার মা। মানুষ হয়েও, ঈশ্বরসম করুণাময়ী আমার মা।
একদিন, হাঁড়িতে ভাত ফুটছে, তো উনুনটা হটাৎ নিভে গেলো। ঘুঁটেগুলো বড় ভিজে। মা তাই চোঙা দিয়ে, প্রাণপণে ফুঁ দিয়ে উনুন জ্বালানোর চেষ্টা করলো। ধোঁয়াতে, মায়ের চোখ ভয়ঙ্কর জ্বালা করছে, তবুও মা প্রাণপণে, চোঙা দিয়ে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছে।
অথচ আমি? অধৈর্য্য। অসংবেদনশীল। দূরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে আমি কাঁদছি, আর মাকে ভর্ৎসনার সুরে বলছি-
আমাকে একটুও ভালোবাসো না তুমি। কতক্ষণ থেকে বলছি, খিদে পেয়েছে আমার! তবুও তুমি খেতে দিচ্ছো না আমায়!
মা তখনও, চোঙা দিয়ে ফুঁ দিয়ে উনুন জ্বালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। হটাৎ আমি, মায়ের চুলের ঝুঁটি ধরে, নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললাম-
বলো, কেন খেতে দাও নি তুমি? বলো, কেন খেতে দাও নি তুমি?
আমার দেওয়া যন্ত্রণায়, মুহূর্তেই অজ্ঞান হয়ে গেলো মা। ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলাম আমি। মা..... মাগো.........।
কিছুক্ষণ পর, চোখ মেলে তাকালো মা। চোখ খুলতেই মায়ের মুখে হাসি। সেই হাসির মধ্য দিয়ে দেখলাম, মায়ের চোখে, জল চক চক করছে। দুঃখে নয়। ক্রোধে নয়। করুণায়। পরম করুণায়।
আমার কপালে হাত দিয়ে, আমাকে বুকে টেনে নিলো মা। বললো-
'বাবা অমল, চল, তোকে তোর কাকীমার বাড়ি থেকে খাইয়ে নিয়ে আসি। '
আমার মায়ের জল ভরা চোখে, সর্ব্ব-বিজয়ী আগুন আছে। যে আগুন- আমার জীবনের সব বাধাকে, মুহূর্তের মধ্যে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে। মায়ের কথা ভেবে, আমার চোখের মধ্যে, একটা তাচ্ছিল্যের হাসি জেগে উঠলো। নিজেকে বললাম-
ধুস, মাত্র ৪২ ডিগ্রী তাপমাত্রা? মাত্র তিন ঘন্টা ড্রিল প্রাক্টিস? হে জীবন, আনো, কত স্ফুলিঙ্গ আছে তোমার আগুনে। কত বজ্র আছে, তোমার কালো মেঘে। যতদিন এ বুকে, আমার মায়ের ছবি আছে, ততদিন তোমরা, হারাতে পারবে না আমায়। ততদিন তোমরা হারবেই আমার কাছে।
© অরুণ মাজী