উত্তরণ খন্ড ৪৫ (Trishna) Poem by Arun Maji

উত্তরণ খন্ড ৪৫ (Trishna)

উত্তরণ খন্ড ৪৫ অরুণ মাজীর উপন্যাস কার্গিল যুদ্ধক্ষেত্রের গল্প
--------------------
বিকেল গড়িয়ে গেলো, তবুও ফায়ারিং বন্ধ হলো না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো, তবুও ফায়ারিং বন্ধ হলো না। সন্ধ্যে গড়িয়ে যখন, রাত গাঢ় হতে শুরু করলো, তখন আমাদের পক্ষ থেকে আক্রমণ একটু কমিয়ে দেওয়া হলো। আর্টিলারি, মর্টার ফায়ারিং বন্ধ করা হলো।  কিন্তু দূর পাল্লার মেশিন গান ফায়ারিং চালিয়ে যাওয়া হলো।

প্রায় আট ঘন্টা ধরে লাগাতার আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ চললো। ইতিমধ্যেই খবর পেয়েছি, আমাদের ইউনিটের আরও এক সৈনিক আহত হয়েছেন। আর আমাদের পাশের ব্যাটালিয়ন, ডোগরা রেজিমেন্টের এক সৈনিক নিহত হয়েছেন।

'নিহত' কথাটা শুনতেই, মন বেশ ভেঙে গেলো আমার। খবরটা শুনে আমাদের COর মনটাও, বেশ খারাপ হয়ে গেলো। উনি কিছু বললেন না। কেবল আরও বেশি গুম হয়ে গেলেন।

শেলিং বন্ধ হলে, CO, কোম্পানী কমান্ডারদেরকে বললেন-
Listen Tigers, I don't want any more casualty.
Keep everyone safe and under shelter.
Evacuate casualties, to base headquarter. Do it now. I am sending doc to base headquarter.'

CO ফোন রেখে দিয়ে আমার দিকে চেয়ে দেখলেন। বললেন-
'Doc, let's go to base headquarter.'

বুঝলাম, আহতদের সঙ্গে দেখা করতে, CO বেস হেডকোয়ার্টারে যেতে চাইছেন। CO এবার  2IC-র দিকে চেয়ে বললেন-
'Venki, hold the fort.
Stay on the line with tigers.
I am taking doc to base.'

CO এবার আমার দিকে চেয়ে বললেন-
Let's go doc.

ট্যাক হেডকোয়ার্টার টপ থেকে, সটান নীচে নেমে এলাম আমরা। হেলিপ্যাডে পৌঁছতেই দেখলাম, CO-র ড্রাইভার, আর রক্ষী বাহিনীও হাজির।

আর্মিতে সবাই রেডি। সর্বক্ষণ রেডি। আর্মিতে সব কিছু যেন অটোমেটিক ঘটে। COর ড্রাইভার আর তার রক্ষী বাহিনীর নজর, সদাই CO র উপর। তাই CO নামতেই, মুর্হুর্তেই তারা হাজির। আলাদা করে কাউকে ডাকাডাকির দরকার হলো না।

আমি আমার RAP-র দিকে যাবো, এমন সময় দেখি, আমার চোখের সামনে এম্বুলেন্স হাজির। দেখলাম, এম্বুলেন্স ড্রাইভারের পাশে হাবিলদার কিষেন বসে। কিষেন উঁকি মেরে আমাকে জিজ্ঞেস করলো-
কাঁহা যানা সাহাব?

আমি কিছু বলার আগেই, CO কিষেনকে বললো-
'তুমলোগ হামারা পিছে আও, কিষেণ'

ড্রাইভারকে পিছনে বসতে বলে, CO মারুতি জিপসির ড্রাইভারের সিটে বসলেন। উনি আমাকে, ওনার পাশের সিটে বসতে বললেন।

শত্রুপক্ষও তখনও ফায়ারিং করে চলেছে। কাজেই গাড়ির হেডলাইট, খুব সাবধানে ব্যবহার করতে হলো।

আগে বলি নি। পাহাড়ের দুটো দিক। একটা দিক পাকিস্তানের দিকে ঢাল হয়ে নেমেছে। অন্য দিক ভারতের দিকে ঢাল হয়ে নেমেছে।

আমাদের রাস্তাগুলো সব, আমাদের দিকের ঢালে। তাই উঁচু পাহাড়, রক্ষা করে আমাদের রাস্তাগুলোকে। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায়, পাহাড়ের সেই সুরক্ষা থাকে না।

তাই সেই অংশে আমাদের কোন গাড়ি যাতায়াত করলে, সেই গাড়ির আলো, পাকিস্তান দেখতে পাবে। এই অংশগুলো তাই বেশি বিপজ্জনক। এই অংশগুলোতে, কেবল ছোট্ট কনভয় লাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে হয়।

আমাদের 'বেস হেডকোয়ার্টারে', আমার 'MI ROOM' (Medical Inspection Room) . ট্যাক হেডকোয়ার্টারের RAP-র চেয়ে, এই MI Room অনেক বেশী বড়। অনেক বেশি সুসজ্জিত।

প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত, আমি এই MI Room-এ থাকি। MI Room-এ আমি, Sick Parade এটেন্ড করি।

(রুগীরা, ডাক্তারের অফিসে এটেন্ড করার  নাম হলো, Sick Parade. আর্মিতে, সৈনিকরা যখন কোন কিছু এক সাথে করে। এবং তা নির্দিষ্ট ক্রম রীতি মেনে করে, তাকে বলে প্যারেড। মন্দিরের আরতি অনুষ্ঠানকেও, Mandir Parade বলি আমরা। মন্দিরে দেবতার পূজাও, ভয়ঙ্কর শৃঙ্খলার সাথে একটা ক্রম রীতি অনুযায়ী করা হয়।)

বেশ ধীর গতিতে MI রুমে পৌঁছলাম আমরা। আমার অফিসে পৌঁছেই, অফিসের একটা চেয়ার COর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। CO তাতে বসলেন।

এম্বুলেন্স ড্রাইভারকে চা বানাতে বললাম আমি। এই চা শুধু CO বা আমার জন্য নয়। আহতদের জন্য, এবং আহতদেরকে নিয়ে যারা এখানে আসতে চলেছে, তাদের জন্যও।

হাবিলদার কিষেণ বেশ অভিজ্ঞ। ছাব্বিশ বছর নার্সিং এসিট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছে। ওকে সঙ্গে নিয়ে, আহতদের জন্য, দুটো বেড রেডি করলাম আমি।

দশ মিনিটের মধ্যে আহত দুজন এসে পড়লো। তাদেরকে আসতে দেখে CO চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন। দেখলাম, আহত দুজন সৈনিক, পায়ে হেঁটেই গাড়ি থেকে নামলো। যদিও তাদের মুখে যন্ত্রণার ছাপ বেশ স্পষ্ট। ওদেরকে পায়ে হেঁটে নামতে দেখে, বেশ আশ্বস্ত হলাম আমি।

আহত দুজনকে দুটো বেডে শুইয়ে দিলাম আমি। কিষেণকে আমি বললাম, ওদের জামা কাপড় খুলে, ওদেরকে  ভালো করে expose করতে। ওদেরকে  exposed করার পর, ওদের গায়ে গরম ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে দিলাম।

ইতিমধ্যে আমি, ওদের ব্লাড প্রেসার, টেম্পারেচার, অক্সিজেন স্যাচুরেশান মেপে, তা নোট করে রাখলাম। দেখলাম, ওদের সব ভাইট্যালস বেশ নরম্যাল।

ওদের আঘাতগুলোকে দ্রুত পরীক্ষা করলাম আমি। দেখলাম, একজনের উরুতে 'স্প্লিন্টার' লেগেছে। আর একজনের কাঁধে। দুজনেরই এন্ট্রি উন্ড রয়েছে। কিন্তু এক্সিট উন্ড নেই। এর অর্থ 'স্প্লিন্টার' এখনো উন্ডের মধ্যেই ঢুকে রয়েছে।  

কিষেণ IV সেট তৈরী করতে শুরু করলো। আর আমি EMST(Early Management of Severe Trauma) প্রোটোকল অনুযায়ী, ওদেরকে পরীক্ষা করা শুরু করলাম। এই প্রোটোকল অনুযায়ী, রোগীকে নিম্নলিখিত ক্রমঅনুসারে পরীক্ষা করতে হয়-
Airway - with cervical spine control
Breathing
Circulation including control of exsanguinating external haemorrhage
Disability
Exposure

পরীক্ষা শেষে COকে বললাম। এদেরকে দুজনকেই হাসপাতালে পাঠাতে হবে। কারন- এদের দুজনের উন্ডেই, স্প্লিন্টার ঢুকে রয়েছে।

CO ব্রিগেড কম্যান্ডারের সাথে কথা বললেন। ঠিক হলো, এদেরকে ব্রিগেড হেডকোর্টারের হেলিপ্যাড পর্যন্ত, এম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর হেলিকপ্টারে করে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।

IV সেট রেডি হলে, আমি ওদের হাতে IV লাইন তৈরী করে, ওদেরকে ফ্লুইড দেওয়া শুরু করলাম। ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন ওষুধের প্রতি ওদের এলার্জি আছে কি না।  ওরা না বললে, ওদেরকে দুজনকে ব্যথার ওষুধ, আর এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশান দিলাম।

সব শেষে, ওদের ব্লাড প্রেশার টেম্পারেচার মাপলাম আমি। দেখলাম, সে সবই বেশ স্থিতিশীল। এবার CO-র দিকে চেয়ে বললাম-
We are good to go sir.

CO
'Are you going? '

If you don't object.

CO
'Firing is still on. We need you here.'

তো ঠিক হলো, রুগীদের সঙ্গে কিষেণ যাবে। ক্ষনিকের মধ্যে এম্বুলেন্স ড্রাইভার তার কাজ করলো। MI Room এর দরজার মুখে, এম্বুলেন্স এনে ফেললো। আহত দুজনকে দ্রুত এম্বুলেন্সে তুলে দিলাম আমরা।

প্রটেকশান গাড়ি সঙ্গে নিয়ে, এম্বুলেন্স রওনা দিলো। CO আমার দিকে চেয়ে হাসলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। বিভিন্ন পোস্ট থেকে আগত, সৈনিকদেরকে উদ্দেশ্য করে আমি বললাম-
বুলা, আপলোগ বহত আচ্ছা কাম কিয়া। আপকা খেয়াল রাখ না।

ওরা সমস্বরে জবাব দিলো-
আপ ভি সাহাব।

COর দিকে চেয়ে দেখলাম আমি। উনি আমার কাছে এসে, আমার কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন-
Now, let's go back. Our job is not done yet.

এখন মধ্য রাত্রি। আমরা পাহাড় চড়তে শুরু করলাম। শুধু পাথরের পাহাড় নয়। ১৩০ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খার পাহাড়। হটাৎ  
ভাবলাম, কজন ভারতীয় এই মুহূর্তে জানে, প্রায় বারো ঘন্টা হয়ে গেলো, যুদ্ধক্ষেত্রের এই সৈনিকরা এখনো একটু খাওয়ার সময় পায় নি?  
-
© Arun Maji

উত্তরণ খন্ড ৪৫ (Trishna)
Sunday, May 16, 2021
Topic(s) of this poem: bangla,romance
COMMENTS OF THE POEM
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Close
Error Success