উত্তরণ ৬৯ক (Trishna) Poem by Arun Maji

উত্তরণ ৬৯ক (Trishna)

মা দিদি আর আমি, নেমে এলাম রাস্তায়। ঠাম্মা তখনো ঘুমুচ্ছে। তাই ঠাম্মাকে আর ডিস্টার্ব করলাম না।
-
রাস্তায় নামতেই, কয়েক জোড়া চোখ আমাদের দিকে চেয়ে দেখলো। চোখে তাদের একটু বিস্ময়। একটু কৌতূহল। কৌতূহল না হওয়ার কোন কারন নেই। কারন, অনেক বছর আমরা তিনজন একসাথে এভাবে হাঁটি নি। দিদি আর আমি যখন শিশু বা কিশোর বয়স্ক ছিলাম, তখন এভাবে মায়ের সাথে হেঁটেছি আমরা।
-
তারপর দিদির বিয়ে হয়ে গেলো। আমি স্কুল থেকে মেডিক্যাল কলেজে গেলাম। তারপর আর্মিতে। মায়ের কাছ থেকে একপ্রকার ছিন্নমূল হয়ে গেলাম আমরা।
-
একটু এগিয়ে যেতেই, তিন্নির মায়ের সাথে দেখা। তিন্নির মা দিদির দিকে চেয়ে বললো-
বাণী তুইও এসেছিস? কবে এলি?
দিদির কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে, তিন্নির মা যোগ করলেন-
বড়দি, এদেরকে নিয়ে একদিন এসো আমাদের বাড়িতে।
-
মা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লো। তারপর এগিয়ে গেলো। আরও একটু এগিয়ে যেতেই, বৃন্দি বুড়ীর সাথে দেখা। বৃন্দি বুড়ী আমার চিবুক ছুঁয়ে মাকে বললেন-
তোর ছেলে, কত বড় হয়ে গেছে বড় বৌ। ওর বিয়ে দিবি না?
মা হাসলো। বললো-
দেবো কাকীমা। যখন দেবো, তখন তোমাকেও ডাকবো।
বৃন্দি বুড়ী খুশী হলেন। দিদির আর আমার, চিবুক ছুঁয়ে উনি চলে গেলেন।
-
আরও একটু পথ এগিয়ে গেলাম আমরা। যেতে যেতে ভাবলাম, কি আশ্চর্য্য! মা চিরদিন এ পাড়ার 'বড় বৌ' হয়ে রয়ে গেলো। কেউ মাকে, বড়বৌ নামে ডাকে। কেউ ডাকে বড় দি। কেউ ডাকে বড় জেঠিমা।
-
রাস্তাটা এখানে বেশ ফাঁকা। রাস্তার ডানদিকে ছোট এক জঙ্গল। জঙ্গলের পিছনে আয়তাকার এক পুকুর। আর বাঁ দিকে সরু খাল। আর খালের ওপারে সবুজ মাঠ। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ।
-
জঙ্গলের কাছাকাছি হতেই, হটাৎই মা, দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করলো। তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে, জঙ্গলের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মা।
-
এখানে শ্মশান। আমার বাবার শ্মশান। শ্মশান বলে আর চেনা যায় না জায়গাটাকে। বেশ কিছু গাব গাছ আর আম গাছ, ঢেকে ফেলেছে জায়গাটাকে। সঙ্গে, কিছু লতানো সবুজ গাছ। জঙ্গলটা বেশ ঘন। তবুও কিন্তু জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, বেশ দেখা যায় পিছনের পুকুরটাকে।
-
মা বলে, আমিই নাকি মুখাগ্নি করেছিলাম বাবার। অথচ কিছুই মনে পড়ে না আমার।
-
মনে পড়ে না, তবুও কিন্তু মাঝে মাঝে একটা স্বপ্ন দেখি আমি। দেখি, এই জঙ্গলের মাঝে, কাঠের চিতার উপর বাবার দেহ। নিথর নিঃস্তব্ধ। সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা।
-
উঁচু কাঠের চিতার উপর, বাবাকে স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছি না আমি। দেখছি কেবল, সাদা কাপড়ের খুঁটটা চিতা বেয়ে ঝুলছে। কাপড়ের খুঁটটা টেনে, বাবাকে বারবার জাগানোর চেষ্টা করছি আমি। কিন্তু বাবা আর জাগছে না। তারপর, বেশী টানাটানি করতে গিয়ে, চিতার কয়েকটা কাঠ গড়িয়ে পড়লো। কাঠগুলো গড়িয়ে পড়তেই, স্বপ্ন ভেঙে গেলো আমার।
-
এই স্বপ্ন, মাঝেই মাঝেই দেখি আমি। কেন দেখি? জানি না। আমি সত্যিই জানি না।
-
হয়তো, ছোটবেলার স্মৃতি মনে করতে না পারলেও, সেই স্মৃতি আমার subconscious-এ রয়ে গেছে। সেই subconscious, বারবার স্বপ্ন রূপে জেগে উঠে আমার মধ্যে।
-
মাকে এখানে দাঁড়াতে দেখে, স্বপ্নটা আবার মনে পড়লো আমার। চোখটা ছলছল করে উঠলো আমার। দিদির দিকে তাকালাম। দিদির চোখেও জল। মায়ের দিকে তাকালাম- দেখি, মায়েরও চিবুক বেয়ে, জল গড়িয়ে পড়ছে।
-
কিন্তু কোন কথা বললো না মা। কেবল জঙ্গলের দিকে চেয়ে রইলো। মাকে দাঁড়াতে দেখে, আমরা দুজন, মায়ের দুপাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মায়ের বাঁদিকে দিদি। আর ডানদিকে, আমি।
-
আমরা দুজন মায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। মা আমাদের দুজনের হাত চেপে ধরলো। তারপর জঙ্গলের দিকে চেয়ে, বাবাকে উদ্দেশ্য করে মৃদু গলায় বললো-
শুনছো, তোমার অমল বড় হয়ে গেছে। ওর বিয়ে দেবো। অনুমতি দাও তুমি।
-
কথাগুলো বলেই অঝোরে কেঁদে ফেললো মা। মাকে কাঁদতে দেখে, মাকে জড়িয়ে ধরলাম আমরা। কিছুক্ষণ এইভাবে দাঁড়ানোর পর দিদি বললো-
'চলো মা, এবার মাঠ থেকে ঘুড়ে আসি আমরা।'
ডাঃ অরুণ মাজী

উত্তরণ ৬৯ক (Trishna)
Thursday, June 24, 2021
Topic(s) of this poem: love,bangla
COMMENTS OF THE POEM
READ THIS POEM IN OTHER LANGUAGES
Close
Error Success