উত্তরণ ৫৫ / কার্গিল যুদ্ধের কাহিনী অবলম্বনে অরুণ মাজীর উপন্যাস
'অমল,
কেমন আছিস বাবা? কতদিন দেখিনি তোকে। বুকটা আমার ফঙ ফঙ করছে বাবা। যখন তুই কাছে কাছে থাকতিস, তখন বেঁচে থাকার একটু জোর পেতাম। কিন্তু আজ?
আজ তুই দূরে। বাণী তার শ্বশুর বাড়িতে। তৃষ্ণা দূরে। চৈতি শ্রী, তারাও দূরে। তোর ছোট কাকা, সেও দূরে। ঘরে কেবল আমি আর তোর ঠাম্মা। কাকে নিয়ে আমরা বেঁচে থাকবো বাবা?
তোর ঠাম্মার শরীর ভালো নয়। কথাই কথাই সে তোর নাম স্মরণ করে। বলে, ' অমলকে তোরা কোথায় পাঠিয়ে দিলি বড় বৌ? কবে আসবে আমার অমল? তাকে একটু দেখতে চাই আমি।'
তোর দিদিও, তোর কথা ভেবে কাঁদে। বলে- 'কতদিন দেখি নি ভাইকে'। বেচারা দীপও তোকে খুব মনে করে।
প্রায় এক বছর হয়ে গেলো, চলে গেলি তুই। আমাদেরকে কি, একটুও মনে পড়ে না তোর?
তোর বাবা নেই। তো আমি অর্থহীন। সম্পদহীন। তোকে তাই, আমার কাছে থাকতে বাধ্য করতে পারি নি। কিন্তু বুকটা যে আমার বড় কাঁদে অমল। একটু ছুটি নিয়ে আসতে পারিস না তুই?
তৃষ্ণা চিঠি লিখেছে আমাকে। নভেম্বরে, ও আসছে কলকাতায়।
দেখতে দেখতে পূজা এসে গেলো। আজ ষষ্ঠী। আজ রাতে, চৈতি আর শ্রীর, বোম্বে থেকে কলকাতা ফেরার কথা। জানিস? ওরা আমাকে কলকাতায় আসতে বলেছে। কিন্তু বৃদ্ধা শ্বাশুড়ীকে ছেড়ে, কোথাও কি যেতে পারি আমি?
তোর ছোট কাকা হয়তো, এক দুদিনের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে। ছোট ফিরলে, হয়তো একবার চেষ্টা করবো। নইলে, ওদেরকেই এখানে আসতে বলবো আমি।
এখন পূজার সময়, অথচ তুই নেই কাছে। বুকটা বড় শূন্য শূন্য লাগছে বাবা। এতদিন যেখানেই থাকিস না কেন, পূজার সময় তুই আমার কাছে থাকতিস। বুকটা তখন ভরে যেতো আমার।
তুইই বল, তুই ছাড়া কি আছে আমার? তোর জন্যই তো আমার বেঁচে থাকা। তোর বাবা, মারা যাওয়ার সময় বলেছিলো আমাকে- 'আমার অমলকে বুকে করে রেখো, জাহ্নবী'।
তোকে বুকে আর রাখতে পারলাম কই? বড় হয়েছিস তুই। তো উড়ে গেছিস তুই। খাঁচা খোলা পাখির মতো উড়ে গেছিস তুই। বাধা দিই কি করে? তোর মা আমি। তোকে কি আমি খাঁচার যন্ত্রণা দিতে পারি?
তুই খোলা আকাশে ডানা মেলে উড়বি। হৈচৈ করবি। আনন্দ করবি। তাতেই আমার আনন্দ। আমার বুক, ফাটে ফাটুক। কিন্তু তোর মুখে তো হাসি ফুটবে। সেই হাসিই আমার হাসি।
আমার রক্ত দিয়ে গড়েছি তোকে। তো তোর হাসির জন্য, ফাটা বুকের হাহাকার সহ্য করতে পারবো না আমি? বেশ পারবো। তোর জন্য আমি, সব কিছু সইতে পারবো। সইতে পারবো বলেই তো বেঁচে আছি বাবা।
তবে কি জানিস? তবুও একটু দেখতে ইচ্ছে হয় তোকে। বুকে জড়িয়ে একটু চুমু খেতে ইচ্ছে হয় তোকে।
ত্যাগী হতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু পারি না। স্নেহের বন্ধনটা, থেকে থেকে, মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মুক্ত আকাশে ছেড়ে দিতে চাই তোকে, কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে, কাছে বসিয়ে খাওয়াতে ইচ্ছে হয় তোকে। একটু বকতে ইচ্ছে হয় তোকে। আবার বকা শেষে, বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয় তোকে।
দিনগুলো হুহু করে বয়ে যাচ্ছে অমল। একদিন তোর ঠাম্মা মৃত্যুর বুকে ঢলে পড়বে। একদিন আমিও মৃত্যুর বুকে ঢলে পড়বো। কিন্তু মৃত্যুর বুকে ঢলে পড়ার আগে, তোকে বুকে জড়িয়ে একটু চুমু খেতে চাই বাবা।
তুই ভালো থাকিস। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তুই ভালো থাকিস, সুখে থাকিস।
ইতি
তোর মা'
মা, আমার মা। জীবনদায়ী মা। পরমেশ্বর মা। পড়তে পড়তে কেঁদে ফেললাম আমি। প্রথমে মনে মনে কাঁদলাম। তারপর হাপুস নয়নে কাঁদলাম।
চোখের সামনে ভেসে উঠলো, কয়েক সপ্তাহ আগের সেই ছবি। CO তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে, হাপুস নয়নে কাঁদছেন। ভেসে উঠলো, COর সেই অপরাধবোধ। তার মায়ের মৃত্যুর সময়, CO তার কাছে থাকতে পারেন নি। মৃত্যুর সময় তার মা, তাকে দেখে যেতে পারেন নি।
বুকটা আমার ভারী হয়ে উঠলো। পাথরের মতো নয়। পাহাড়ের মতো। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। নদীর মতো নয়। সমুদ্রের মতো।
চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো আমার। ভাবলাম, নাহঃ মায়ের কাছে আমাকে যেতেই হবে। আমার ছুটি চাই। হ্যাঁ, আমার ছুটি চাই।
চিঠিটা হাতে নিয়ে এক নিমেষে দৌড়ে গেলাম আমি। ঠিকানা COর অফিস। আমাকে দেখে CO বললেন-
What's up doc?
কোন কথা না বলে, COর টেবিলের উপর মায়ের চিঠিটা মেলে ধরলাম আমি। চিঠির দিকে নজর রেখে CO বললেন-
'What is this? I cannot read Bengali. '
My mother's letter.
'What did she write? '
She is crying.
'Hmm'
CO এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমার কাঁধে হাত রেখে উনি বললেন-
'Yes, you can go on leave.'
Really? When?
'Let me speak to the CO of Field Ambulance, Let me organize your replacement for a month. Then I would let you know.'
You mean, you are approving one month's leave?
'Yes. I am.'
CO কে স্যালুট করে আমি বললাম-
You are the best sir.
CO আবার আমার কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন-
'I could not see my mother when she was dying. I don't want you to have that same misfortune.'
CO হাসলেন। বললেন-
'You know doc, the mother is our only God. We are made of her blood.'
This poem has not been translated into any other language yet.
I would like to translate this poem