কার্গিল যুদ্ধ অবলম্বনে অরুণ মাজীর উপন্যাস উত্তরণ ২৬ক © অরুণ মাজী
------------------------
'আলোকে ভালো করে বুঝতে চাইলে, আগে আপনাকে আঁধার দেখতে হবে। জীবন কি, তা বুঝতে হলে, আগে আপনাকে মৃত্যুর সাথে রাত্রি বাস করতে হবে। বন্ধুত্ব কি, তা বুঝতে হলে, আগে আপনাকে শত্রুর নখের আঁচড় খেতে হবে। সাহাব, জীবনে অনেক কমরেডারি (Comradery / Camararaderie) দেখেছি আমি; কিন্তু ভারতীয় ফৌজের মতো কমরেডারি, কখনো কোথাও দেখিনি আমি।'
সুবেদার মেজর করণ সিং, এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে আমার দিকে তাকালেন। করণ সিং, লক্ষ্নৌগামী এই ট্রেনে, আমার সাথী।
উনিও হাওড়া থেকে লক্ষ্নৌ যাচ্ছেন। উনি কলকাতায় অবস্থিত, গাড়োয়াল রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর। ওনার যখন সতেরো বছর বয়স, উনি গাড়োয়াল রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন। টানা পয়ঁত্রিশ বছর, একই রেজিমেন্টে কাজ করার পর আজ উনি সুবেদার মেজর।
'সাহাব, একটু চা খাবেন? '
সম্মতির সুরে ঘাড় নাড়লাম আমি। চাওয়ালা চা নিয়ে এলে, করণ সিং তাকে দাম দিতে উদ্যত হলেন। ওনাকে বাধা দিয়ে, টাকাটা আমি পেমেন্ট করলাম। ইন্ডিয়ান আর্মির সংস্কৃতি অনুযায়ী, সিনিয়র সবসময় জুনিয়রকে দেখভাল করবে। কাজেই চায়ের খরচ, আমার দেওয়া কর্তব্য।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, উনি বললেন--
'সাহাব, মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখি আমরা। তাই হলফ করে বলতে পারি আমি, যে কোন সিভিলিয়ান ব্যক্তির চেয়ে, জীবনকে আমরা বেশি ভালো করে বুঝি। জীবনকে আমরা বেশি শ্রদ্ধা করি। মানুষকেও আমরা অনেক বেশী শ্রদ্ধা করি। আমরা শত্রুর সাথে রাত্রি বাস করি, তাই আমরা বন্ধুত্বকেও, যে কোন মানুষের চেয়ে বেশী শ্রদ্ধা করি।
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সিভিলিয়ান জনগণ জানে না, আমাদের এই ত্যাগের কথা, আমাদের এই নিষ্ঠার কথা। তারা জানে, আমরা শুধু মানুষ খুন করি।'
কথাগুলো বলে, করণ সিং চায়ে চুমুক দিলো আবার। তার পর বললেন-
জীবনকে যখন আমরা এতো ভালোবাসি, তখন কি কারও জীবন হরণ করতে ইচ্ছে করে আমাদের? নাহঃ করে না।
তবুও আমাদের করতে হয়। জীবনে, অনেক কিছু না চাইলেও তা করতে হয়। আমরা ঘৃণা করতে চাই না, তবুও আমাদেরকে ঘৃণা করতে শেখানো হয়। আমরা মানুষ খুন করতে চাই না, তবুও আমাদেরকে মানুষ খুন করতে শেখানো হয়। আমাদের কানের সামনে বারবার বলা হয়- 'এক গোলি, এক দুশমন।' আমরা চাই না, তবুও এসব কাজ আমাদেরকে করতে হয়। সাহাব, পেটের দায় বড় দায়।
আমাদের যারা শত্রু, তাদেরকেও সেই একই জিনিস শেখানো হয়। তারা অপেক্ষায় রয়েছে, আমাদের বুকে গুলি বিঁধে দেওয়ার জন্য। আর আমরা অপেক্ষায় রয়েছি, ওদের বুকে গুলি বিঁধে দেওয়ার জন্য। '
করণ সিং কথাগুলো বলে একটু যেন দমে গেলেন। উদাসী হয়ে, জানালার মধ্য দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলেন উনি।
একটার পর একটা, সবুজ মাঠ, ঘড়-বাড়ি, কলকারখানা, বাজার, পুকুর ডোবা- আমাদের চোখের সামনে মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠছে। তারপর মুহূর্তেই তা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম-
তাহলে দেশপ্রেম কি?
'উন্মাদের উন্মাদনা। যখন আমি অল্পবয়সী সৈনিক ছিলাম, তখন আমি এসবে বিশ্বাস করতাম। আজকাল তা করি না। আমার ছেলের বয়সী সৈনিকের গুলিবিদ্ধ, রক্তাক্ত দেহ প্রতিদিন দেখি আমি। তাদের বিধবাদের হৃদয়ের হাহাকার প্রতিদিন শুনি আমি। তাদের সন্তানদের, অসহায় আর্তনাদ প্রতিদিন অনুভব করি আমি। সাহাব, যুদ্ধ তো আমরা অনেক করছি, কিন্তু তাতে শান্তি কি এসেছে?
যুদ্ধ দিয়ে কোথায় শান্তি এসেছে সাহাব? কোথায়? ইরাক আফগানিস্তান এখনো জ্বলছে। কাশ্মীর এখনো জ্বলছে। সুদান সোমালিয়া এখনো ক্ষত বিক্ষত। এতো তো যুদ্ধ হলো, শান্তি কোথায়?
আপনিই বলুন সাহাব, এসব যুদ্ধে কারা মরে? মরে আমার মতো গরীব, অসহায় সৈনিকরা। আর অসংখ্য নিরীহ জনগণ। কিন্তু যুদ্ধগুলো বাঁধায় কে? কিছু স্বার্থান্বেষী নেতা আর ব্যবসায়ী। তারা যুদ্ধ বাঁধায়, তাদের খ্যাতি আর প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য। দশ জন লোকের লোভের জন্য, দশ কোটি লোক মরে।
যুদ্ধে মারা গেলে, একটা মরণোত্তর সন্মান পাবো আমি। কিন্তু তাতে কি আমার বিধবা স্ত্রীর হৃদয়ের হাহাকার মিটবে? তার পেট চলবে? আমার ছেলে, তার বাবাকে ফিরে পাবে? একটা মরণোত্তর সম্মানের কাগজ দিয়ে কি, আমার স্ত্রীর তার সংসার চালাতে পারবে?
সাহাব, দেশপ্রেম একটা আফিম। জনগণকে শাসন করার আফিম। শোষণ করার আফিম। অল্পবয়সী সৈনিকদেরকে বুদ্ধু বানানোর আফিম।
যে ভালোবাসা দেশের মধ্যে শান্তি আর সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনে, সেই হলো সত্যিকারের দেশপ্রেম। যুদ্ধ কোন কি কখনো শান্তি আনে না? সমৃদ্ধিও আনে? যুদ্ধে যদি দেশের মঙ্গলই হবে, তো ইরাক ইরান সিরিয়া আফগানিস্তানে এতো যুদ্ধ হলেও, তারা এখনো শান্তি পায় নি কেন? তারা এখনো সমৃদ্ধ হয় নি কেন? যুদ্ধ মানসিকতা কখনো দেশপ্রেম হতে পারে না। এসব দুষ্টের মিথ্যে ভাষণ। এসব জনগণকে শাসন করার আফিম। শোষণ করার আফিম।
করণ সিং-এর কথাগুলো উড়িয়ে দিতে পারলাম মা। তাই চুপ করে শুনে গেলাম আমি। মৃদু স্বরে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম আমি-
আপনার ভয় করে না? এসব কথবার্তা বললে, লোকে তো আপনাকে দেশদ্রোহী বলবে!
Sunday, March 28, 2021
Topic(s) of this poem: bangla,political,love and war,war and peace,war